মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৩, ০৭:৫৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রস্তুতি ছাড়াই সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস

প্রস্তুতি ছাড়াই সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস

চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা ও স্বাস্থ্য কাঠামোর প্রস্তুতি ছাড়া পাস হয়েছে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস নীতিমালা-২০২৩। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে এ নীতিমালা কার্যকর হওয়ার কথা। প্রাথমিক পর্যায়ে ১০ জেলার ২০ উপজেলায় সেবা চালু হবে। তবে কোন জেলায় এ সেবা শুরু হবে, সেই তালিকা এখনো প্রণয়ন করতে পারেনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। আগামী দুদিনের মধ্যে তালিকা তৈরির কথা জানা গেছে। এদিকে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিয়ে দেশের চিকিৎসকদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ। চিকিৎসকরা বলছেন, সরকারি দায়িত্ব পালনের পর অনেক চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাকটিসে আগ্রহী নন। আবার দেশের প্রান্তিকের স্বাস্থ্যকাঠামো এখনো নড়বড়ে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। সংকট রয়েছে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের।

এমন পরিস্থিতিতে ভোটের আগে সাধারণ মানুষকে চমকে দিতেই এই নীতিমালা বাস্তবায়নের ঘোষণা বলেই মত জনস্বাস্থ্যবিদের। যদিও প্রধানমন্ত্রী একাদশ জাতীয় সংসদে সরকার গঠনের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ইনস্টিটিউশনাল নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন; কিন্তু ডেঙ্গু-করোনার দোহাই দিয়ে তখন বাস্তবায়ন করা হয়নি। নির্বাচনী বছরে তড়িঘড়ি করে পাস করা হলো নীতিমালা। এতে চিকিৎসক এবং সেবা গ্রহীতা উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবাকে ঘিরে বিতর্ক আরও বাড়তে পারে বলেও মত বিশেষজ্ঞদের।

সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা আগামী ৩০ মার্চ বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত নিজ হাসপাতালেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করবেন। এতে নার্স ও টেকনিশিয়ানরাও সপ্তাহে দুদিন করে কাজ করবেন। তারা যে সেবা দেবেন, তার বিনিময়ে তাদের সম্মানী নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি অংশ পাবেন চিকিৎসকরা। সরকারও একটি অংশ পাবে। বর্তমানে সরকারের বেতনভুক্ত চিকিৎসকরা তার কর্ম সময়ের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখার সুযোগ পান। তারা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত চেম্বার বসিয়ে ফির বিনিময়ে রোগী দেখেন। এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত রোগী দেখার সুযোগ করে দেয়। স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানের পর বেসরকারি বারডেমও একই পথ অনুসরণ করে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সারা দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪৫৫টি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনের মধ্যে ২০৬টি মেশিন বিকল। আবার ৭৪৬টি এক্স-রে মেশিনের মধ্যে ৩৫৪টি সচল আর বিকল ৩৯২টি। সনোলজিস্টের পদ নেই। টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ। সরকারের ক্ষতি হচ্ছে শত কোটি টাকা।

নীতিমালা বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল সোমবার জানান, আমরা দুই-তিন মাস ধরে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল, এ টার্মের শুরুতেই ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস শুরু করা হোক। কিন্তু ডেঙ্গু ও করোনার কারণে তা আমরা শুরু করতে পারিনি। প্রাথমিকভাবে ১০টি জেলা হাসপাতালে এবং ২০ উপজেলা হাসপাতালে পাইলটিংভাবে এ কার্যক্রম শুরু হবে। পরে বাকি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে এ সেবা দেওয়া হবে।

মন্ত্রী বলেন, চিকিৎসকরা সপ্তাহে দুই দিন করে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের আওতায় রোগী দেখবেন। প্রাইভেট প্র্যাকটিসের আওতায় রোগী দেখাতে অধ্যাপককে ৫০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপককে ৪০০ টাকা, সহকারী অধ্যাপককে ৩০০ টাকা এবং অন্যান্য চিকিৎসককে ২০০ টাকা করে ফি দিতে হবে। যে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা থেকে অধ্যাপকরা ৪০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপকরা ৩০০ টাকা, সহকারী অধ্যাপকরা ২০০ টাকা এবং অন্যান্য চিকিৎসকরা ১৫০ টাকা করে পাবেন। বাকি টাকা সার্ভিস চার্জ বাবদ কাটা হবে এবং চিকিৎসকদের সহায়তাকরীরা পাবেন। রোগী দেখায় চিকিৎসককে সহায়তা করবেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও নার্সরা। রোগী যে ফি দেবেন, তা থেকে চিকিৎসককে সহায়তাকারী নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পাবেন ৫০ টাকা। বাকি ৫০ টাকা হাসপাতাল রাখবে। রোগীর কাছ থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ ফি আদায় করবে হাসপাতাল, চিকিৎসকরা মাস শেষে তাদের পাওনা টাকা পাবেন।

জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. কবির হোসেন কালবেলাকে বলেন, ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস নীতিমালার সঙ্গে প্রান্তিকের চিকিৎসকরা সেভাবে অবগত নন। চিকিৎসক সমাজ বিষয়টি সেভাবে একসেপ্টও করেনি। কারণ এটি পসিবলও না। এই নীতিমালা কার্যকর হতে পারে শুধু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের জন্য। আমরা আমাদের হাসপাতালে ৮ থেকে ১০ জন চিকিৎসক আছি। এর মধ্যে ২/৩ জন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। ম্যক্সিমাম কিন্তু পড়াশোনা করেন। কিংবা পরিবারকে সময় দেন। তিনি আরও বলেন, জোর করে একটা নীতিমালা কার্যকর কর যায় না। প্রাইভেট প্র্যাকটিস একটি ব্যক্তিগত বিষয়। যদি এমন হতো এই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার প্রতিমাসে ফিক্সড সেলারি নির্ধারণ করত। তাহলে হয়তো কিছুটা আগ্রহ দেখা যেত। কিন্তু সেই সুযোগ নেই। এই প্র্যাকটিস নীতিমালা কার্যকর করতে হলে পুরো হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন করতে হবে। আমার মনে হয় মন্ত্রণালয় এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন দেখা যাক তারা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারেন।

স্বাস্থ্য অধিকার বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. রশীদ ই মাহবুব কালবেলাকে বলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস নীতিমালা পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড। কথা হচ্ছে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস করাতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কন্ডিশন ফলো করতে হয়। কিন্তু ওনারা যেটা করছেন, তারা ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস করাচ্ছেন না। তারা জুনিয়র চিকিৎসকদের ইনস্টিটিউশনাল কনসালটেশন করাচ্ছেন। ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস একটা টোটাল প্যাকেজ। কনসালটেশন, ইনভেস্টিগেশন, ডায়াগনোসিস অ্যান্ড হেলথ সার্ভিস ডেলিভারি। এই প্র্যাকটিস শুধু দেশের ফাইভ স্টার হাসপাতালগুলোতে করা হয়। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে যারা চাকরি করে তাদের বেলা ২টা পর্যন্ত দায়িত্ব। এরপরের সময়টাতে তাদের বাইরে প্র্যাকটিসের অনুমোদন সরকারই দিয়েছে। সুতরাং আমার কাছে এই ব্যবস্থাপনাকে একটা ভাঁওতাবাজি মনে হচ্ছে। আমরা যেই প্রতিষ্ঠানকে ধরে বলছি ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের কথা সেই বিএসএমএমইউর ম্যান পাওয়ার অনেক। তবুও তারা শুধু কনসালটেশনটা করতে পারছে। মেডিকেল কলেজের বাইরে সবার পক্ষে এসব নীতিমালা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল কালবেলাকে বলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে, নীতিমালাটি বাস্তবায়ন এখন খুব একটা সুন্দর জিনিস হবে না। কারণ এখনো আমরা প্রান্তিক পর্যায়ে প্রস্তুত নই। যদিও মন্ত্রী (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) বলছেন, আমরা এটা পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে চালু করছি। একটি বিষয় খটকা লেগে যায়। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা দিনে বিনে পয়সায় অফিস করবেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানেই অফিস পরে তারা অর্থের বিনিময়ে রোগী দেখবেন। এইটা শুনতেই কেমন যেন মনে হয়। এতে রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। আমি মন্ত্রণালয়ের সভায়ও বলেছি, এই নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য আরেকটু সময় দরকার ছিল।

তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনে স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটা রাউন্ড টেবিল বৈঠক করা যেত। শুধু মন্ত্রণালয় যদি একা এই নীতিমালা ইপ্লিমেন্ট করতে যায়। তাহলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। এটা নিয়ে আরেকটু কথা বার্তা বললে ভালো হতো। যারা সার্ভিস দেবেন, যারা নেবেন আবার জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন। সবার পরামর্শ নিয়ে কাজটি করা হলে ভালো হতো।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হা-মীম গ্রুপে জনবল নিয়োগ, আবেদন করুন শুধু পুরুষরা

স্বাধীনতা ক্রীড়া সংঘের নবযাত্রা

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক : চরমোনাই পীর

বিশ্বের কোথাও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিখুঁত নয় : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

চড় মারতেই অজ্ঞান স্ত্রী, মৃত ভেবে স্বামীর আত্মহত্যা

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার নিবন্ধ / ‘যুদ্ধে নয় বরং পৃথিবী রক্ষায় অর্থ ব্যয় করা দরকার’

বঙ্গোপসাগরে জাহাজডুবি, নিখোঁজ ১১ নাবিক

তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী : মির্জা আব্বাস

ঝালকাঠির ৪ উপজেলায় ইসতিসকার নামাজ আদায়

সাবধান! ঢাকার রাস্তায় ভয়ংকর প্রতারক চক্র, হারাবেন সর্বস্ব

১০

অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা চুয়েট, হল ছাড়ার নির্দেশ

১১

বৃষ্টির জন্য শিক্ষার্থীদের ইসতিসকার নামাজ আদায়

১২

পাহাড়ি গ্রামে পানির কষ্টে মানুষ

১৩

নতুন শিক্ষাক্রমে ক্লাসে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী নয় : শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী

১৪

রেলের ভাড়া বৃদ্ধিতে প্রতিবাদ

১৫

একটি বইয়ের আলেখ্য

১৬

যে কারণে আল্লাহতায়ালা বৃষ্টি বন্ধ করে দেন

১৭

বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে বাস সহায়তা দেবে ববি কর্তৃপক্ষ

১৮

অনিয়ম ঢাকতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে বাধা

১৯

কমিউনিটি ব্যাংকে ক্যাড়িয়ার গড়ার সুযোগ, কর্মস্থল ঢাকা

২০
*/ ?>
X