মৃত্তিকা সাহা
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০১:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

টাকা ফেরতে নতুন আশা

টাকা ফেরতে নতুন আশা

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির সাত বছর আজ শনিবার। এখন পর্যন্ত চুরি যাওয়া এ অর্থের মধ্যে ফেরত আনা গেছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। বাকি ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার (টাকার অঙ্কে ৫৬০ কোটি টাকা) পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অর্থ ফেরত পাওয়ার আশ্বাসও পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাইবার হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির প্রয়াস চালায় হ্যাকাররা। এর মধ্যে বানান বিভ্রাটের কারণে রাউটিং ব্যাংকের সন্দেহ হলে দুর্বৃত্তরা শ্রীলঙ্কামুখী ২ কোটি ডলার হাতিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১০ কোটি টাকা ম্যানিলাভিত্তিক রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) হয়ে প্রবেশ করে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ক্যাসিনোয়। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে আলোচনার ঝড় তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক অব নিউইয়র্কে গচ্ছিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা।

আদালতে ভরসা : গত ১৩ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির মামলা বাতিলের দুই আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন নিউইয়র্কের আদালত। অভিযুক্তদের আগামী ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে এবং একই সঙ্গে মধ্যস্থতার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিউইয়র্কের আদালতের এ রায়ের ফলে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির মামলার অভিযুক্ত ফিলিপাইনের আরসিবিসি, কিম অংসহ ১৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা চলার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা নেই। এর মাধ্যমে রিজার্ভের চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে বিএফআইউ।

আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, নিউইয়র্কের ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ক্ষেত্রে আরসিবিসির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যোগসাজশ ছিল। আরসিবিসির নিউইয়র্কের হিসাব এবং আরসিবিসির ফিলিপাইনের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের সহযোগিতা না থাকলে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে এ অর্থ অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল না।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্ক বা ফেডারেল আদালতে ফিলিপাইনের বেসরকারি খাতের ব্যাংক আরসিবিসিসহ ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

চুরি হওয়া রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারে এ মামলা করা হয়। পরে ওই মামলা বাতিলে সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন করে আরসিবিসিসহ ছয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ফেডারেল আদালত ২০২০ সালের ২০ মার্চ মামলা বাতিলের ওই আবেদন খারিজ করে মামলাটি ফেডারেল আদালতের বদলে স্টেট কোর্টে পরিচালনার নির্দেশ দেন।

ফেডারেল আদালতের ওই নির্দেশনার পর ২০২০ সালের ২৭ মে নিউইয়র্কের সুপ্রিম কোর্ট তথা ডিস্ট্রিক্ট আদালতে নতুন করে মামলা করে বাংলাদেশ। নতুন আদালতেও মামলা বাতিলের আবেদন করে আরসিবিসিসহ ছয় আসামি। তাদের এ আবেদনের ওপর একাধিক দফায় শুনানি হয়।

মামলার অগ্রগতি নিয়ে বৈঠকে বাংলাদেশ-ফিলিপাইন : জানা গেছে, রিজার্ভ চুরির ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের মধ্যে ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার নিয়ে ফিলিপাইনের আদালতে কমপক্ষে ১২টি মামলা চলমান। এর মধ্যে বড় অঙ্কের অর্থ জব্দও করে রেখেছে দেশটির আদালত। চলমান এসব মামলার অগ্রগতি বিষয়ে জানতে এবং এসব মামলার গতি বাড়াতে ফিলিপাইন গেছে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল। পাঁচ সদস্যের এই প্রতিনিধি দল গত সোমবার ফিলিপাইনের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ ছাড়া একটি মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন সিআইডির দুজন কর্মকর্তা। যুক্তরাষ্ট্রের আলাদতের দেওয়া রায়ের বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠকও করেছে প্রতিনিধি দল।

প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসিসহ বিএফআইইউ ও সিআইডির দুজন করে কর্মকর্তাও আছেন। এ ছাড়া ওই দলে যোগ দেবেন ফিলিপাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। আজ শনিবার প্রতিনিধি দলের দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, নিউইয়র্কের আদালতের এ রায়ের ফলে চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তবে কবে নাগাদ এ অর্থ পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আদালতের রায়ের পরপরই বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল ফিলিপাইনে গেছে। সেখানে বেশ কয়েকটি মামলায় আমাদের দুজন পুলিশসহ বিএফআইইউর প্রতিনিধি সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি সভা করেছে প্রতিনিধি দল। সেখানে ভালো অগ্রগতি আছে। অর্থাৎ ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তবে ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে যে সমঝোতার কথা বলেছিলেন নিউইয়র্ক আদালত, সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তৎকালীন গভর্নরের পদত্যাগ : ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক একদিন পরে চুরির তথ্য জানতে পারে; কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা গোপন রাখে আরও ২৪ দিন। আর বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় চুরি যাওয়ার ৩৩তম দিনে।

এর ফলে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হলেও বাংলাদেশে আর কারও বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল সরকার। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল অরক্ষিত, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন দায়িত্বহীন। আর চূড়ান্ত সর্বনাশ ঘটানো হয় আন্তর্জাতিক লেনদেনের নেটওয়ার্ক সুইফট সার্ভারের সঙ্গে স্থানীয় লেনদেনের নেটওয়ার্ক জুড়ে দিয়ে।

সাত বছরেও আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন : রিজার্ভ চুরির বিষয়টি জানাজানি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। একই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক মতিঝিল থানায় মামলা করে এবং পরের দিন মামলা হস্তান্তর করা হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডির কাছে। ফরাসউদ্দিন কমিটি কাজ শুরু করে ২০ মার্চ থেকে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে, একই বছরের ৩০ মে তদন্ত প্রতিবেদন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পেশ করে; কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকার ফরাসউদ্দিন কমিটির সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এমনকি অনুসন্ধান শেষ করে অভিযোগপত্রও দেয়নি সিআইডি। এ কারণে দেশের মানুষ আজও জানতে পারেনি রিজার্ভ চুরি যাওয়ার নেপথ্যে কারা ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের যান্ত্রিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে হ্যাকাররা : মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের দশম তলায় অত্যন্ত সুরক্ষিত ঘরের অভ্যন্তরে বসানো ছিল প্রিন্টারটি। কোটি কোটি ডলারের ট্রান্সফার ব্যাংকের বাইরে ও ভেতরে প্রবাহিত হওয়ার রেকর্ড ছাপানো হতো এটি দিয়ে।

শুরুতে কর্মকর্তাদের কাছে আগে থেকেই ত্রুটিপূর্ণ এ প্রিন্টার ছিল কেবল একটি ঝামেলা। প্রযুক্তির সমস্যা ছাড়া তেমন একটা বড় ব্যাপার বলে মনে হয়নি কারও কাছে। চুরি যাওয়ার পর ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট থেকে প্রিন্টারটি কাজ করছিল না। তাই এদিন কেউ বিষয়টি নিয়ে তেমন মাথাব্যথা দেখাননি। সে সময় ডিউটি ম্যানেজার ছিলেন জুবায়ের বিন হুদা। পরে তিনি পুলিশকে বলেছিলেন, ‘আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, এটি অন্য যে কোনো দিনের মতো একটি সাধারণ সমস্যা, এর আগেও এমন হয়েছে।’

হ্যাকাররা চুরির টাকা সরানোর জন্য আগে থেকেই ফিলিপাইনের ম্যানিলাকে বেছে নেয়। তবে এক জায়গায় এতগুলো আদেশ দিলে সমস্যা হতে পারে ভেবে তারা শ্রীলঙ্কায়ও একটি আদেশ দেয়। আর এতেই বিপত্তি দেখা দেয়।

ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে (আরসিবিসি) খোলা ব্যাংক হিসাবে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ ডলার এবং শ্রীলঙ্কার শালিখা ফাউন্ডেশনের নামে আরও ২ কোটি ডলার স্থানান্তরের আদেশ দেওয়া হলেও ইংরেজি ‘ফাউন্ডেশন’ বানানে ‘ও’ অক্ষরটি ছিল না। এই ভুল বানানের কারণে শালিখা ফাউন্ডেশনের নামে পাঠানো অর্থ স্থানান্তর হওয়ার আগেই আটকে যায়, যা পরে ফেরত আসে। কিন্তু ফিলিপাইনে পাঠানো চারটি হিসাবে অর্থ স্থানান্তর হয়ে যায়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১২ কেজি গাঁজাসহ দুই মাদক কারবারি গ্রেপ্তার

অটোভ্যান ছিনতাই করে চালককে হত্যা, গ্রেপ্তার ৩

ইরানে ইসরায়েলের হামলা শুরু

৩১ জেলায় আবহাওয়া নিয়ে দুঃসংবাদ

ছুটির দিনটি কেমন যাবে আপনার?

সিনেমা হলের জায়গা বিক্রি, নির্মাণ হবে মাদরাসা

ভারতে লোকসভার ভোট শুরু আজ

পাবনায় চিনিবোঝাই ১২ ট্রাকসহ আটক ২৩

তীব্র গরমে ছয় বিভাগে স্বস্তির খবর

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

১০

১৯ এপ্রিল : নামাজের সময়সূচি

১১

জুমার দিনের গুরুত্বপূর্ণ যেসব আমল

১২

শুক্রবার ঢাকার যেসব এলাকায় যাবেন না

১৩

ছাত্রলীগ নেতার পা ভেঙে ফেলার হুমকি দিলেন এমপি

১৪

দাজ্জালের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো যে সাহাবির

১৫

লোহাগড়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ / কুপিয়ে জখম ৩

১৬

চুয়াডাঙ্গায় হিট অ্যালার্ট জারি

১৭

৮০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা, সতর্কতা জারি

১৮

পাবলিশহার এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড পেলেন মিতিয়া ওসমান

১৯

৮৪ জন গ্রাউন্ড সার্ভিস এসিস্টেন্ট নিয়োগ দিল বিমান

২০
*/ ?>
X