হাসান আজাদ
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০২:৩৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আসছে লোডশেডিংয়ের খড়্গ

আসছে লোডশেডিংয়ের খড়্গ

মাঘ মাসেও শীত নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর শীত না থাকার কারণে বেড়ে গেছে বিদ্যুতের চাহিদা। উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ার কারণে সারা দেশে এই শীতেও লোডশেডিং হচ্ছে। সরকারি হিসাবে কমবেশি দেড়শ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের কথা বলা হলেও কার্যত এর পরিমাণ অনেক বেশি। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেই বাড়বে লোডশেডিং।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আসন্ন গ্রীষ্ম মৌসুম, সেচ মৌসুম ও রমজানে লোডশেডিং থাকবে না। এ জন্য বেশ কিছু উদ্যোগও নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল উপাদান গ্যাস, ডিজেল-ফার্নেস অয়েল ও কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এই তিনটি পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার মেগাওয়াটেরও কম। জ্বালানি সংকটে ৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ ১৩টি কেন্দ্র। এগুলোর সম্মিলিত ক্ষমতা ৩ হাজার ২২৮ মেগাওয়াট।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গেল বছরের ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ওই সময় বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট। তবে চলতি বছরের গ্রীষ্মে এই চাহিদা বেড়ে সাড়ে ১৬ হাজার হবে বলে জানান পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ওই কর্মকর্তারা জানান, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবারের শীতকালীন পরিস্থিতির বেশ পার্থক্য রয়েছে। শীতে সাধারণত বিদ্যুতের চাহিদা কমে যায়। তবে এবার শীতে চাহিদার যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি চাহিদা ছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জ্বালানি সংকট। জ্বালানি কিনতে ডলার সংকট, যে কারণে শীতেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে, যা এখনো চলমান। গত ১০ দিনে গড়ে ৫৫০ মেগাওয়াট থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা হয়েছে।

এ প্রেক্ষাপটে গত ২৪ জানুয়ারি আসন্ন সেচ, রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভা শেষে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, সেচ মৌসুমে তেমন লোডশেডিং থাকবে না। সেচ মৌসুমে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে উৎপাদনও বাড়ানো হচ্ছে। পিডিবি যাতে চাহিদামতো গ্যাস এবং জ্বালানি তেল পায়, সেজন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিপিসিকে চাহিদার অতিরিক্ত ফার্নেস অয়েল কেনার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট ধরা হলেও এটি ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যেই থাকবে। চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানির অভাবে, বিশেষ করে বিশ্ব বাজারে জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনের দিনগুলো লোডশেডিং মুক্ত রাখা সম্ভব হবে না। চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা নেই সরকারের। জ্বালানি পণ্য কেনার মতো ডলার নেই। এ ছাড়া সরকারের পরিকল্পনায় ছিল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ফেব্রুয়ারি-মার্চে উৎপাদনে আসবে। সেটিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ, কয়লা প্রাপ্তি ও আমদানি অনিশ্চিত। এমনকি স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি ফের শুরু করলেও বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান হবে না। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদকরা বিদ্যুতের বিল না পাওয়ার কারণে তারাও বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে ১২ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, মার্চে ১৪ হাজার ১০০, এপ্রিলে ১৬ হাজার, মে মাসে ১৬ হাজার, জুনে ১৫ হাজার ৮০০, জুলাইয়ে ১৫ হাজার ৭০০, আগস্টে ১৫ হাজার ৬০০, সেপ্টেম্বরে ১৫ হাজার ৫৮০, অক্টোবরে ১৫ হাজার, নভেম্বরে ১৩ হাজার ৮০০ এবং ডিসেম্বরে ১২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট।

জানা গেছে, ডলার সংকটে সরকারি ও বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় তেল ও গ্যাস আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। গত জুলাই থেকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ। অর্থাভাবে গ্যাসের আমদানি বিল ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। জানুয়ারি মাস পর্যন্ত জমা বিলের অর্ধেক পরিশোধের মতো টাকা আছে পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাবে। নতুন করে ১০টি এলএনজি কার্গো আমদানি করতে হলে আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে। টাকা না পেলে আমদানি করার সুযোগ নেই।

একই ধরনের নেতিবাচক অবস্থায় বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিস্থিতি। বেসরকারি খাতের মোট ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। বেসরকারি খাতের প্রায় সবগুলোর ফার্নেস অয়েল নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র। বর্তমানে বেসরকারি খাতের আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রয়োজন ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল। এই পরিমাণ তেল কিনতে বছরে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। সেখানে বর্তমানে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও কম পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকরা পিডিবির কাছে ৬ মাসের বকেয়া বিলের টাকা পায়। যার পরিমাণ ২২৭ দশমিক ৫০ বিলিয়ন টাকা। এই অবস্থা চলতে থাকলে সামনে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন আরও কমে যাবে।

এদিকে আগামী মার্চের শেষ দিকে ভারতের আদানি থেকে অতি উচ্চ দামে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। মে মাসের দিকে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে ৬১২ মেগাওয়াট এবং আরও কিছু ছোট বা মাঝারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৫০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হতে পারে। এপ্রিল-মে মাসের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হবে। তখন এসব কেন্দ্র উৎপাদনে এলেও বড়জোর ১৩ হাজার মেগাওয়াটের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। এর পরেও ঘাটতি থেকে যাবে।

চলতি অর্থবছর এলএনজি আমদানিতে সরকার ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি রেখেছে। গ্যাসের বর্ধিত দামের কারণে চলতি অর্থবছর সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে ২৭ হাজার কোটি টাকা। এ ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৫০০০ কোটি টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স হিসেবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে। ফলে ২২ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়তি অর্থ থাকবে পেট্রোবাংলার হাতে। এই বাড়তি টাকা অন্যান্য ঘাটতি মেটানোর পর স্পট মার্কেট থেকে ১০-১২ কার্গো এলএনজি আনতে পারবে সংস্থাটি। সরকারের পরিকল্পনা মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে ১১-১২ কার্গো এলএনজি কেনা। মার্চে দুটি এবং মে-জুন পর্যন্ত ৩টি করে ৯ কার্গো আনার কথা। ফেব্রুয়ারিতেও একটি কার্গো আনার চেষ্টা চলছে বলে পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

পিডিবি বলছে, দৈনিক গ্যাসের সরবরাহ ৩ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট হলে বিদ্যুৎ ও শিল্পের চাহিদা যথাসম্ভব মেটানো যাবে। তবে সিএনজি ও আবাসিকে গ্যাস রেশনিং করতে হবে। বর্তমানে পেট্রোবাংলা দিনে সরবরাহ করছে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সংশ্লিষ্টদের মতে, এক কার্গো এলএনজি এলে দিনে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ বাড়ে। মাসে দুই কার্গো এলএনজি এলে দৈনিক সরবরাহ বাড়বে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তিন কার্গো এলে সরবরাহ বাড়বে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে দৈনিক ১০০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকবে। এ ছাড়া সম্প্রতি ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বিল বকেয়া থাকায় কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আমদানির এলসি খুলতে চাইছে না।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন কালবেলাকে বলেন, তীব্র শীতেও সরকার বিদ্যুতের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে লোডশেডিংও হয়েছে। শীতে যেখানে লোডশেডিং মুক্ত করতে পারেনি, সেখানে গরমে পারবে সেটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তিনি আরও বলেন, সরকার মূলত সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়ার আশায় ছিল। মার্চের মধ্যে এ বিদ্যুৎ আসবে বলা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। জ্বালানি কেনার বিষয়টিও এখনো পরিষ্কার হয়নি। এ ছাড়া ডলার সংকটের কারণে ফুয়েল আমদানি করতে পারছে না। ফলে আগামী গ্রীষ্মে প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হবে। তবে সাশ্রয় নীতির মাধ্যমে ১ হাজার মেগাওয়াট এবং উচ্চমূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে আরও ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারে সরকার। এর পরও অন্তত ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপি আরেক নেতা বহিষ্কার

ওমরাহ নিয়ে বড় সুখবর দিল সৌদি সরকার

বঙ্গোপসাগরে জাহাজ ডুবিতে ১১ নাবিক উদ্ধার, নিখোঁজ ১

বাংলাদেশকে অন্য দেশের চোখ দিয়ে দেখে না যুক্তরাষ্ট্র : মার্কিন কর্মকর্তা

তপ্ত রোদে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের নামাজ আদায়

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা / জবি ক্যাম্পাসে গাড়ি প্রবেশ নিষেধ 

বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় দিয়ে কিডনি কেটে বিক্রি করেন মিল্টন সমাদ্দার?

গণঅধিকার পরিষদের খাবার পানি ও ফল বিতরণ

সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পদে মেঘনা গ্রুপে চাকরি, কর্মস্থল ঢাকা

ফের মাউশির ডিজি হলেন অধ্যাপক নেহাল

১০

আজও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়

১১

স্বাস্থ্য শিক্ষার এডিজি হলেন স্বাচিপ মহাসচিব

১২

উপনির্বাচনকে সামনে রেখে ফের উত্তপ্ত শৈলকুপা

১৩

হিটস্ট্রোকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

১৪

চাঁদা না পেয়ে ছাত্রলীগ নেতাকে বেধড়ক পিটুনি

১৫

সাংবাদিকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি মামলা

১৬

স্ত্রীর দাবি, সালমান শাহ-শাকিবের মতোই এবার টার্গেট জয়

১৭

প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু, গুরুতর অপরাধে লঘু মামলা হয়েছে

১৮

বাংলাদেশের উন্নতি দেখে আমাদের লজ্জা হয় : পাক প্রধানমন্ত্রী

১৯

শাহজাদপুরে বৃষ্টি কামনায় ইসতেসকার নামাজ আদায়

২০
*/ ?>
X