
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত দ্রব্যমূল্য তালিকা নিয়ে করা মূল্যস্ফীতির তথ্যে অধিকাংশ ব্যবহারকারীই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ব্যবহারকারীদের ৫৮ দশমিক ৬৭ শতাংশই এ খাতে বিবিএসের তথ্যে অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। বাকি ৪১ দশমিক ৩৩ শতাংশ ব্যবহারকারী সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। স্বয়ং বিবিএসের জরিপে উঠে এসেছে এমন তথ্য। তবে নিজেদের কার্যক্রম নিয়ে এমন জরিপ করায় প্রশংসা পাচ্ছে বিবিএস।
গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস মিলনায়তনে প্রথমবারের মতো ‘বিবিএস ইউজার স্যাটিসফিকশন সার্ভে (ইউএসএস)-২০২২’ শীর্ষক জপির প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। বিবিএস সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন। সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান। এ ছাড়া অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।
বিবিএসের সেবা এবং তথ্য সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের ভাবনা এবং ভবিষ্যতে পরিসংখ্যান তৈরিতে উন্নতি করতে পরামর্শ জানতে এই জরিপ করেছে সংস্থাটি। এ কাজে ৬০৯ জনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এক্ষেত্রে তারা প্রায় ১৪টি খাতের সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়েছে। গত বছরের ২৭ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত চলে এই জরিপ কার্যক্রম।
বিবিএসের জরিপে মূল্যতালিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে বলা হয়, ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষ মনে করে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয় না, ২৯ দশমিক ১৭ শতাংশ মানুষ মনে করে পুরোনো তথ্য, ৪৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ মনে করে তথ্য ব্যবহারযোগ্য নয়। ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ মনে করে আরও বেশি তথ্য সংগ্রহ করা উচিত এবং ১২ দশমিক ৫ শতাংশ মনে করে তথ্য উপস্থাপন উপযুক্ত না।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, পৃথিবীর সব দেশের তথ্য-উপাত্ত ভুল ত্রুটি আছে। বিবিএস যে একদম সঠিক তথ্য দিতে পারবে না, এমনটি নয়। তবে আগের তুলনায় তথ্য-উপাত্ত মানোন্নয়ন হয়েছে। তিনি বলেন, নিজেদের সম্পর্কে ব্যবহারকারীর মতামত প্রকাশ করে বিবিএস সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। জরিপের ফলটা গ্রহণযোগ্যই মনে হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের পরিসংখ্যানে যে মানুষের অসন্তুষ্টি আছে সেটির কারণ তারা এখানে প্রকাশ করেছেন। এখানে অনেক পরামর্শ উঠে এসেছে, মতামত এসেছে।
তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের পরিসংখ্যান মূল্যস্ফীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি এবং এর তথ্য নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টি বেশি। কারণ, তারা ভাবে মূল্যস্ফীতি কমেছে অথচ ডিমের দাম বেড়েছে তার মানে মূল্যস্ফীতির তথ্য ভুল; কিন্তু মূল্যস্ফীতির তথ্যে প্রায় ৪২২টি পণ্যের মূল্য বিবেচনা করা হয়। সেখানে এক অথবা দুটি পণ্যের দাম বাড়লেও পাশাপাশি অন্য অনেক পণ্যের দাম কমে। সেটি সাধারণ কেউ দেখে না। তবে এক্ষেত্রে সংশোধনের অনেক সুযোগ রয়েছে। সময় নিয়ে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে তারপর নির্ভুল মূল্যস্ফীতি তথ্য প্রকাশ করার পরামর্শ দেন তিনি।
জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে অভিমত ব্যক্ত করেন পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, যে কোনো নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সঠিক পরিসংখ্যান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পরিসংখ্যান প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিবিএস আগের থেকে উন্নতি করেছে। তবে সময়মতো এবং বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
বিবিএসের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন বলেন, পরিসংখ্যানের গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই মানসম্মত পরিসংখ্যান প্রণয়ন এবং নির্ভুল তথ্য প্রকাশ করা দরকার হয়ে পড়েছে। বিবিএস সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের ধারণা এবং মতামত জানার জন্যই মূলত প্রথমবারের মতো এ জরিপ করা হয়েছে। জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নিজেদের দুর্বলতা এবং সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ গ্রহণ করে নির্ভুল পরিসংখ্যান ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কাজ করা হবে। এই জরিপে বিবিএসের চাহিদা যে অনেক বেশি সেটিও উঠেছে। বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন এবং ব্যবস্থাপনার জন্য সঠিক তথ্য অপরিহার্য। তথ্যের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যেই কাজ করা হচ্ছে।
বিবিএসের মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান বলেন, জরিপের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিবিএসের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত পরিসংখ্যান নিয়ে ব্যবহারকারী ও অংশীজনের সন্তুষ্টির মাত্রা নিরূপণ ও তাদের মতামত এবং পরামর্শ গ্রহণ করা। জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা হিসেবে বিবিএসের সার্বিক মানোন্নয়নে ও সরকারি পরিসংখ্যান প্রণয়নে অধিকতর সক্ষম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। জরিপ পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, এবং গণমাধ্যমসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন।
বিবিএসের জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিবিএসের তথ্য ব্যবহারকারীর ৩৫ শতাংশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। বাকি ৬৫ শতাংশ ব্যবহারকারীরা মনে করেন তারা তাদের (বিবিএস) তথ্যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তারা প্রত্যাশা করেন আরও বেশি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে পরিসংখ্যান তৈরি করতে হবে।
বিবিএস বলছে, জরিপে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী উত্তরদাতাদের বিবিএস তথ্য ব্যবহারকারীর মধ্যে ৭২ দশমিক ৯৯ শতাংশ ‘ভালো’ এবং ১২ দশমিক ৬৭ শতাংশ ‘খুব ভালো’ বলে মত দিয়েছেন। এ ছাড়া তথ্যের মান নিয়ে ৮৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ ব্যবহারকারী সন্তুষ্ট ছিল। বিবিএসর তথ্য সব থেকে বেশি ব্যবহার হয় শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে।
জরিপের তথ্য বলছে, ৭০ দশমিক ৫২ শতাংশ জনসংখ্যা, জনমিতি এবং জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে ইত্যাদি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান ব্যবহার করেন। ৪৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ ব্যবহার করেছেন দারিদ্র্যের তথ্য এবং ৪০ শতাংশ ব্যবহার করেছেন কৃষির তথ্য। এ ছাড়া বিবিএস থেকে সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সন্তুষ্টির মাত্রা বিবেচনায় ৬৭ দশমিক ০৬ শতাংশ ব্যবহারকারী সেবা প্রাপ্তি ‘সন্তোষজনক’ বলে মত দিয়েছেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জরিপের ফল নিয়ে পয়েন্ট উপস্থাপন করেন ‘এনএসডিএস ইমপ্লিমেন্টেশন সাপোর্ট প্রজেক্ট’র প্রকল্প পরিচালক মো. দিলদার হোসেন। স্বাগত বক্তব্যে প্রকল্প পরিচালক জরিপের সার্বিক বিষয়ে সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
প্রকল্প পরিচালক জানান, সামগ্রিকভাবে বিবিএস প্রস্তুতকৃত তথ্য সরকারি পরিসংখ্যান শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে সরকারি পরিসংখ্যান ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর ৪৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা অনুসরণ করেননি। বৈদেশিক বাণিজ্য পরিসংখ্যান ব্যবহারকারীর ৭০ দশমিক ০৯ শতাংশ বিবিএসের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত সরকারি পরিসংখ্যানকে ‘উপযোগী’ এবং ১৭ দশমিক ০৯ শতাংশ ‘খুবই উপযোগী’ হিসেবে মত প্রকাশ করেন।