শাহরিয়ার হাসান
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জালিয়াতির সিমে মাদক কারবার মাফিয়াদের

জালিয়াতির সিমে মাদক কারবার মাফিয়াদের

কক্সবাজারের টেকনাফে ১২ কোটি টাকা মূল্যের একটি মাদকের চালানের তদন্ত করতে গিয়ে চারটি মোবাইল নম্বর খুঁজে পান মামলার তদন্তকারী। কল ডিটেইলস রেকর্ড বা সিডিআর বিশ্লেষণ করে দেখেন, ঘটনার দিন ওই ফোনগুলোতে মোট ১১ বার কথা হয়েছিল। নাম-পরিচয় ব্যবহার করেই কেনা হয়েছিল সিমগুলো। তবুও গত এক বছরেও তাদের আসল পরিচয় শনাক্ত করতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

তদন্তকারীরা অবাক হয়েছেন এই দেখে যে, টেকনাফের দরগারছড়ায় ওই ২ কেজি ৫০০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথের চালান পাচার করতে সরাসরি ফোনের অপারেটিং সিস্টেমই বদলে ফেলা হয়েছিল। ব্যবহার করেছিল অন্যের নামে কেনা সিম (জালিয়াতির সিম)। তাই মাদক চালান আর মোবাইল হাতছাড়া হলেও পর্দার আড়ালেই থেকে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন পেছনের কারবারিরা।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হালিম বলেন, মাদকের এমন অনেক মামলা তদন্ত করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কূলকিনারা করতে পারেন না। তাই সব সময় এসব চালানের পেছনে কে বা কারা থাকেন, তা জানাও সম্ভব হয় না।

আর সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির কালবেলাকে বলেছেন, কক্সবাজারের তালিকাভুক্ত ১০১ জন ইয়াবা গডফাদারদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছিলেন তারা। সে অনুসন্ধানে অনেক কিছু পেলেও কারও মোবাইলেই তাদের নামে কেনা ব্যবহৃত সিম পাননি।

ঘটনাটি গত বছরের ১৪ জানুয়ারির। কোস্টগার্ডের তাড়া খেয়ে ফেলে রেখে যাওয়া ব্যাগ থেকে ২ কেজি ৫০০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ জব্দ করা হয়। জব্দের পর ক্রিস্টাল মেথ ও মোবাইলটি কোস্টগার্ড টেকনাফ মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়। সেদিনই দায়ের করা হয় মামলাও। সেই মামলার তদন্তে নেমে ওই চার সিমের ভুয়া মালিককে খুঁজে পান তদন্তকারীরা। পরে জানতে পারেন তাদের তিনজনের বাড়িই কুড়িগ্রামে। থাকেন রাজধানীর মহাখালীর পাশে এক বস্তিতে। জীবিকা নির্বাহ করেন রিকশা চালিয়ে। তাদের সবার নামে ১৩-১৪টি করে সিম রয়েছে। তবে তারা কেউই তা জানতেন না।

মাদক কারবারিদের যেন ছুঁতেই পারছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তথ্যপ্রযুক্তিতে এত ফাঁদ পাতলেও পা ফেলাতে বাধ্য করাতে পারছে না তাদের। যার ফলে দাপটের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার মাদক কারবার। কী সেই রহস্য, যা দীর্ঘদিন ধরে ভেদ করার চেষ্টা করেও পারছেন না গোয়েন্দারা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রালয়ে জাতীয় মাদকবিরোধী কমিটির চতুর্থ সভায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জানিয়েছেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীরা স্মার্টফোন ও আন অথরাইজড সিম ব্যবহার করছে। যে কারণে তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তাই তাদের কথোপকথন মনিটর করা প্রয়োজন।

ওই গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আরও বলেন, এর বাইরে মাদকের প্রবেশ স্থানগুলোতে স্ক্যানারের মতো আরও উন্নত ডিজিটাল ডিভাইস ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা যেতে পারে।’

বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, আসলে আন অথরাইজড সিম ব্যবহার করার আর সুযোগ নেই। কারও না কারও নামে সিম নিবন্ধন করতেই হয়। অবশ্য এ প্রক্রিয়াতেই অপরাধীরা অপকর্ম করে থাকে।

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, কোনোভাবেই এই দায় সিম নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এড়াতে পারে না। তারাই কৌশলে এই অভিনব প্রতারণা করার সুযোগ করে দিচ্ছে।

যেভাবে জালিয়াতি হচ্ছে সিমকার্ড :

অনুসন্ধানে নেমে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই অ্যাকটিভ বা আগে থেকেই অন্যের নামে নিবন্ধন করা সিম বিক্রির একটি বড় চক্র রয়েছে। এ চক্রটি মূলত তিনভাবে সিম জালিয়াতির কাজটি করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, মোবাইল ফোন কোম্পানি যেসব ডিস্ট্রিবিউটর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিম বিক্রি করে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত করা। অতিরিক্ত অর্থের লোভ কিংবা ডিস্ট্রিবিউটর প্রতিষ্ঠানের টার্গেট পূরণ করতে বিক্রয় প্রতিনিধিরা কারও নামে সিম রেজিস্ট্রেশন করার সময় একাধিকবার আঙুলের ছাপ নিয়ে তা সংরক্ষণ করে রাখেন।

এ ছাড়া জালিয়াত চক্রের সদস্যরা রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে নিম্ন আয়ের লোকজন বসবাস করে এমন এলাকায় ফ্রি বা সিমের সঙ্গে নানা উপহারসামগ্রী দেওয়ার নাম করে একই ব্যক্তির একাধিকবার আঙুলের ছাপ ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি সংগ্রহ করে রাখে। পরে সেসব অ্যাকটিভ সিম বিক্রি করা হয় অপরাধী চক্রের কাছে, বেশি দামে। কখনো কখনো খেটে খাওয়া মানুষজন, রিকশাচালক বা বাসাবাড়িতে কাজ করে এমন মানুষজনকে টাকা দিয়েও একাধিক সিম নিবন্ধন করিয়ে রাখা হয়। সেসব বিক্রি করা হয় সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও প্রতারকদের কাছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) পরিচালক (সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিস) লে. কর্নেল এসএম রেজাউর রহমান কালবেলাকে বলেন, এই অব্যবস্থাপনার বিষয়টি একদিনে হয়নি। রাতারাতি সমাধানও করা সম্ভব নয়। আমরা নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছি। আশা করি খুব দ্রুত সমাধানে পৌঁছাব।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিআরসির আরেক কর্মকর্তা বলেন, তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে একটি বিষয় উঠে এসেছে, বেশির ভাগ করপোরেট সিম বেহাত হয়ে যাচ্ছে। যেখানে একটি কোম্পানির নামে ১০০টিরও বেশি সিম তুলে পারে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটি।

‘কনসাইনমেন্ট’ ওপর নজর রাখছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর :

মনে হবে বিদেশ থেকে কোনো বহুজাতিক কোম্পানির বরাত দেওয়া মূল্যবান জিনিস এসেছে। ধরার উপায় নেই, কারণ সেগুলোর বরাত দেওয়া হয়েছে দেশের নামি-দামি কোনো কোম্পানির নাম করে। কিন্তু সন্দেহ হওয়ায় সেই সব বাক্স খুলতেই অবাক হচ্ছেন তদন্তকারীরা। তারা দেখছেন, কাপড় থেকে প্রসাধনী—বিভিন্ন রকম বাক্সের ভেতর থেকে বেরোচ্ছে মাদক। মাদকের এমন কাণ্ড-কারখানা চালাতে এখানেও সরাসরি ফোনের অপারেটিং সিস্টেমই বদলে ফেলা হয়েছে।

গত কয়েক মাসে খাট (ক্যাথিনোন ও ক্যাথিন), ম্যাজিক মাশরুম ও ‘ক্র্যাটম প্লান্ট’ নামের মাদকের অনুপ্রবেশ অনুসরণ করে এমন কারবারে হদিস পেয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এরপর থেকেই ‘ডার্ক ওয়েব’ বা কুরিয়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বহুজাতিক সংস্থার ‘কনসাইনমেন্ট’-এর ওপরও নজর রাখতে শুরু করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, মাদক কারবারিরা বিভিন্ন কৌশল ও পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশে নতুন নতুন মাদক নিয়ে আসছে। তবে আমরাও তৎপর আছি।

সিম থেকে যেভাবে অপরাধী শনাক্ত :

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধারণত মোবাইল ফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড বা সিডিআর বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধীরা জালিয়াতি করে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করায় বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ অপরাধীদের বেশির ভাগেরই সিডিআর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেটি এমন একজনের নামে নিবন্ধন করা, যিনি বিষয়টি জানেনই না।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান কালবেলাকে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যারা অপরাধ করে থাকে তাদের অধিকাংশই অন্যের নামের সিম ব্যবহার করছে। সিআইডি সাইবার পুলিশ একাধিক মিটিং এ সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিষয়টি অবগত করেছে।

মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক অপরাধ ঠেকাতে জাতীয় পরিচয়পত্র ও আঙুলের ছাপ দিয়ে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশন শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন করা হয়েছিল, তা পুরোপুরি সাফল্য পায়নি।

পুলিশের একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, শতকরা ৯৫ ভাগ অপরাধী এখন অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত করছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অপরাধবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, সময়ের সঙ্গে অপরাধের ধরন পাল্টেছে। কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রমাণ দাঁড় করাতে চাইলে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি অপরাধীরা এভাবে জালিয়াতি করে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো তথ্যপ্রমাণে আটকানো যাবে না। নিশ্চিত করা যাবে না শাস্তিও।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চবিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ কর্মীকে মারধর

ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে প্রবাসীর স্ত্রী থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ

সেতুমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়ায় শাহবাগ থানায় জিডি

পদ্মা ব্যাংকের এমডির পদত্যাগ

আদাবরে স্ত্রীর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার, স্বামী পলাতক

ভর্তি পরীক্ষায় জবিতে থাকবে ভ্রাম্যমাণ পানির ট্যাংক

অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি, বিপাকে পুলিশ কনস্টেবল

গরমে বেড়েছে ডায়রিয়া, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ৮৩

একাধিক অন্তরঙ্গ ভিডিও ভাইরাল, কে এই তরুণী

‘পরকীয়ার জেরে’ হত্যা করা হয় মিতুকে : মা

১০

গাজার সেই শহরে আবারও নারকীয় হামলার ঘোষণা

১১

রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদে 

১২

যেসব জেলায় শিলাবৃষ্টির আশঙ্কা

১৩

‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার’

১৪

গাজীপুরে তীব্র দাবদাহে গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ

১৫

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আরও একজনের নাম যুক্ত হচ্ছে

১৬

বিআরটিএ’র অভিযানে ৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকা জরিমানা 

১৭

ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো হয়নি : রেলমন্ত্রী

১৮

সবাইকে আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান মহানগর বিএনপির

১৯

ব্যাংককে নেওয়া হলো বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুকে

২০
*/ ?>
X