
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের উপকমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ করতে চলছে তোড়জোড়। আর এ সময় কমিটিতে জায়গা করে নিতে জোর তদবির চালাচ্ছেন সুযোগসন্ধানী আর আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক এমন ছাত্রনেতারা। নির্বাচনে অংশ নিতে এলাকায় নিজের গুরুত্ব প্রমাণে তাদের কাছে জরুরি হয়ে পড়েছে দলের রাজনৈতিক পরিচয়। সব মিলিয়ে তদবিরের চাপে বেড়ে যাচ্ছে উপকমিটির আকার।
উপকমিটির চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যানের নাম ঘোষণার প্রায় চার মাস হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৪-৫টি উপকমিটি গঠন করে দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুসারে ১৯টি উপকমিটি গঠনের কথা থাকলেও অধিকাংশই জমা পড়েনি। কোনো কোনো উপকমিটির খসড়া তৈরি করলেও অনেকটির গঠনের কাজ এখনো শুরুই হয়নি।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান রাশিদুল আলম বলেন, আমাদের কমিটি তো করাই আছে। গত কমিটি থেকে কিছু যোজন-বিয়োজন করে শিগগির দিয়ে দেব। বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, আমাদের কমিটি এখনো জমা দেওয়া হয়নি। এ মাসেই কমিটি পূর্ণাঙ্গ করে জমা দেব।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর আরেক সদস্য এবং যুব ও ক্রীড়া উপকমিটির চেয়ারম্যান মোজাফফর হোসেন পল্টু কালবেলাকে বলেন, তারা এখনো কাজ শুরু করেননি। তবে শিগগির সংশ্লিষ্ট সম্পাদকের (মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা) সঙ্গে বৈঠক করে কমিটি ঘোষণা করা হবে।
জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে হয়ে যাওয়া ২২তম সম্মেলনের পর চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ১৯টি বিভাগীয় উপকমিটির চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান পদে নাম ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা সংগঠনের গঠনতন্ত্রের ২৫ (৬) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অর্পিত ক্ষমতাবলে বিভাগীয় উপকমিটির চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যানদের মনোনয়ন দেন। সদস্য সচিব হিসেবে থাকেন দলের সংশ্লিষ্ট সম্পাদক।
আলাপকালে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যসচিবরা জানান, তারা উপকমিটি গঠনে চাপে আছেন। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনুরোধ ও নানা মাত্রিক তদবিরের জ্বালায় অতিষ্ঠ বলেও অকপটে স্বীকার করেন। দলের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩৫ সদস্যের উপকমিটি গঠনের কথা থাকলেও সেই সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে বলেও জানান এই নেতারা।
জানা গেছে, শিক্ষা ও মানবসম্পদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণবিষয়ক উপকমিটিসহ ৪-৫টি উপকমিটি দলের দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। এসব কমিটি সম্পর্কে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সবুজ সংকেত পেলে অনুমোদন দেওয়া হবে। আর ত্রাণ উপকমিটির সদস্যের সংখ্যা শতাধিক হওয়ায় তা সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক।
দলের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, উপকমিটিতে আগে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে সক্রিয়দের অনেকেই নতুন কমিটিতে আছেন। কিছু সংশোধন শেষে খুব শিগগিরই এর অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।
আগের মতই শিক্ষা ও মানবসম্পদ উপকমিটিতে থাকছেন উপাচার্য ও শিক্ষকরা। আকারও বেড়েছে। সদস্যের সংখ্যা ৪০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৮। দলের শিক্ষা ও মানবসম্পদ সম্পাদক শামসুন নাহার চাঁপা কালবেলাকে বলেন, উপকমিটি পূর্ণাঙ্গ করে জমা দিয়েছি। আকার কিছু বেড়েছে। এতে গত কমিটির অনেকেই আছেন।
সূত্র বলছে, গত কয়েকটি সম্মেলনে উপকমিটি গঠন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ার ফলে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট কমিটির চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবরা। তবে থেমে নেই সুযোগসন্ধানীরাও। জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে উপকমিটিতে জায়গা পেতে এবং এলাকায় গুরুত্ব প্রমাণে তৎপর হয়ে উঠেছেন বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী। যেভাবেই হোক পদ বাগানোর চেষ্টায় নানা কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে ভিড় করছেন সম্পদশালী অনেকে। কেউ কেউ উপহার পৌঁছে দিয়ে নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। আবার সেই সুযোগে সংসদ নির্বাচনের খরচ জোগাতে কোনো কোনো নেতা পদপ্রত্যাশীদের টার্গেট করেছেন বলেও জানা গেছে।
এদিকে বিতর্ক এড়াতে, দলীয় নির্দেশনা অনুযায়ী জমা দেওয়া উপকমিটির তালিকা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তবে কমিটি গঠনে বরাবরের মতো প্রাধান্য পাবেন সাবেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগের উপকমিটিগুলোতে সদস্য পদের সঙ্গে ‘সহ-সম্পাদক’ পদটিও ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই পদ নিয়ে শুরু হয় বাণিজ্য। টাকার বিনিময়ে অনেকেই পদটি বাগিয়ে নেন। অতীতে দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না কিংবা রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা নেই—এমন ব্যক্তিরাও রাতারাতি দলের কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক বনে যান। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজনীতি করে কেন্দ্রীয় ‘সহ-সম্পাদক’ পদ পাওয়ার ঘটনাও ঘটে। বাদ যাননি সরকারি চাকরিজীবীরাও। এমনকি বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন— এমন অনেকেই কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর নানা কায়দায় আওয়ামী লীগের উপকমিটিতে ঢুকে পড়েন।
এসব কারণে ২০১৯ সালের সম্মেলনে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ‘সহ-সম্পাদক’ পদ তুলে দেওয়া হয়। এর ভিত্তিতেই বিগত কেন্দ্রীয় উপকমিটিগুলোতে চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবের (সংশ্লিষ্ট সম্পাদক) সঙ্গে শুধু সদস্য পদ দেওয়া হয়। ২০২২ সালের সম্মেলনের পর উপকমিটিতে চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব (সংশ্লিষ্ট সম্পাদক) ছাড়াও কো-চেয়ারম্যান হিসেবে নতুন আরেকটি পদ যুক্ত করা হয়।