
যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে থাকা বিএনপি এবার বিভিন্ন খাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির ফিরিস্তি জনগণকে জানাবে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কাজ শুরু করেছেন। এমনিতেই গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১০ দফা দাবিতে তিন মাস ধরে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে আসছে বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় যুগপৎ আন্দোলনের একাদশতম কর্মসূচি হিসেবে আজ শনিবার ঢাকাসহ দেশের সব মহানগরে একযোগে সমাবেশ করবে দলটি।
সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ১০ দফা, নিত্যপণ্যের মূল্য কমানো এবং সর্বব্যাপী দুর্নীতির প্রতিবাদে এই সমাবেশ করবে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক জোটগুলো। এর মাধ্যমে মূলত দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিএনপির কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। আজ এবং আগামী দিনের কর্মসূচিগুলোতে সরকারের দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরবেন নেতারা। সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও তাদের স্বজনদের ব্যক্তিগত দুর্নীতির ফিরিস্তি সামনে আনা হবে। পাশাপাশি এই সরকারের আমলে ভিনদেশের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে একাধিক চুক্তি ও মেগা প্রজেক্টের দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হবে।
সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের হাইকমান্ড। এ ছাড়া রমজান ও স্বাধীনতা দিবস ভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচি থাকায় যুগপতের নতুন কর্মসূচিতে কিছুটা শিথিলতা আসতে পারে বলে জানা গেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, স্থায়ী কমিটির সভায় এই অনির্বাচিত, দুর্নীতিপরায়ণ ও ফ্যাসিস্ট সরকারের দুর্নীতির খতিয়ান জনসমক্ষে উন্মোচন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কারণ, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার এখন যে কোনো মূল্যে রাজস্ব বাড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে। অথচ অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধ করে এ অর্থের জোগান দেওয়া যেত। গত এক যুগে রেন্টাল এবং আইপিপি খাতে খরচ হয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। যার মধ্যে সরকারের অতিঘনিষ্ঠ ১২টি কোম্পানিই নিয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে এবং কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
সংশ্লিষ্ট বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, কৃষি, ক্রীড়াসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা ও ব্যক্তিবিশেষের দুর্নীতির ফিরিস্তি জনগণকে জনাতে ইতোমধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কাজ শুরু করেছেন। সরকারের দুর্নীতির প্রমাণ সংগ্রহে দেশি-বিদেশি মিডিয়া এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারের মেগা প্রজেক্টের দুর্নীতি, বিদেশে কার কী সম্পদ, কোন দেশের সঙ্গে কী চুক্তি করা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করা হবে। বিএনপির সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএনআরসি) তত্ত্বাবধানে ডকুমেন্টারি তৈরি করা হচ্ছে, যা ভার্চুয়াল এবং সভা-সমাবেশ বা সেমিনার কিংবা লিফলেট আকারে বিলি করে জানানো হবে।
বিএনপির ও সমমনা দল এবং জোটের একাধিক নেতা কালবেলাকে জানান, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অতীতে যে সূত্র ব্যবহার করেছিল, একইভাবে এগোতে চাইছে বিএনপিও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য কালবেলাকে গতকাল শুক্রবার জানান, আওয়ামী লীগের এমন কোনো নেতা নেই, যারা দুর্নীতি করেনি। সুতরাং কোন নেতা কী দুর্নীতি করেছে, কার কত সম্পদ ছিল এবং বর্তমানে কত সম্পদ হয়েছে, সেসব বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই জিনিস রেডি। এসব আমরা বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরব। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৪ বছরে দুর্নীতি, তাদের গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ দেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অবস্থা জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে।
বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বর্তমান সরকারের দুর্নীতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু তারা অন্য খাতের মতো শিক্ষা খাতকেও ধ্বংস ও দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়া মানেই তো চরম দুর্নীতি। শুধু টাকা চুরি বা পাচার করাকেই দুর্নীতি বলে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, ভবন নির্মাণ, বিভিন্ন প্রকল্পসহ সর্বত্রই দলীয়করণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আজ শিক্ষার্থীরা কোনো পড়ালেখা না করেও পাস করছে। এই সরকারের আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও চাকরির প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এমতাবস্থায় জিয়াউর রহমান প্রণীত ১৯ দফা এবং সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত ২৭ দফা রূপরেখা বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত ও সমৃদ্ধ হবে।
বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ও বিশিষ্ট ইউরোলজিস্ট ডা. রফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি বলে শেষ করা যাবে না। আওয়ামী লীগ ও দুর্নীতি যেন সমার্থক। এই সরকারের আমলে দেশের চিকিৎসা খাতের রুগ্নদশা জাতির সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। হাসপাতালে শিক্ষক নিয়োগ-পদোন্নতি, মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়েও দুর্নীতি করেছে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপির ছেলে পর্যন্ত জড়িত। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর, তা মহামারি করোনার সময় দেশের মানুষ ভালোভাবেই দেখেছে। আমি মনে করি, ক্ষমতাসীনদের এসব দুর্নীতির ফিরিস্তি জাতিকে নতুনভাবে আবারও জানানো উচিত।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকারকে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ রাজপথের আন্দোলনে মোকাবিলায় হোঁচট খেলেও জোট সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তি ও বিএনপির সিনিয়র নেতা এবং তাদের স্বজনদের দুর্নীতিসহ সরকারের নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড জাতির সামনে উপস্থাপন করে মানসিকভাবে চাপে ফেলেছিল। বিশেষভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমান-বাংলা ভাইয়ের উত্থান এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড তুলে ধরার মধ্য দিয়ে চারদলীয় জোট সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে ফেলেছিল। ফলে নৈতিকভাবে চাপে পড়া বিএনপিতে বিভেদ তৈরি হয়েছিল। ওই চাপ গিয়ে পড়ে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর। যার চূড়ান্ত পরিণতি ওয়ান-ইলেভেনের সৃষ্টি। এরপরই দুর্নীতিসহ নানা মামলায় জর্জরিত হন বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী।
সে অনুযায়ী বিএনপিও এখন ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দেশের টাকা পাচার, ভোট ডাকাতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির তথ্য জাতির সামনে তুলে ধরতে কাজ করছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলো শক্তিশালী। তাদের মোকাবিলা করতে মানসিকভাবে দুর্বল করতে হবে। এ কারণে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে তাদের দলীয় নেতাদের আত্মীয়স্বজনের দুর্নীতির প্রমাণ জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। অন্যদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দুর্নীতি এবং কে কত টাকা বিদেশে পাচার করেছে ইত্যাদি তুলে ধরা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান কালবেলাকে বলেন, এই সরকারের দুর্নীতির ঘটনা বলে শেষ করা যাবে না। এখন যে পরিস্থিতি, এই সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরা সময়ের দাবি। এরই মধ্যে জনগণ বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে সাড়া দিয়েছে। আমরা শনিবার যে সমাবেশ করব, সেখানে সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরা হবে।
আজ সব মহানগরে সমাবেশ
গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক জোট সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছে, এই প্রতিবাদ সমাবেশ তাদের ১১তম। গত তিন মাসে তারা সারা দেশে গণমিছিল, অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ সমাবেশ ও বিভাগীয় সমাবেশ, মানববন্ধন কর্মসূচি করেছে যুগপৎভাবে। এরপর গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা ইউনিয়ন পর্যায় থেকে মহানগর পর্যন্ত কয়েক দফায় পদযাত্রা কর্মসূচি শুরু করে। সর্বশেষ গত ১১ মার্চ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সারা দেশে এক ঘণ্টার মানববন্ধন কর্মসূচি করেছে। আজ শনিবার বিএনপি রাজধানীসহ সব মহানগরে সমাবেশ করবে।
এসব কর্মসূচিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা নেতৃত্ব দেবেন। রাজধানীতে দুপুর ২টায় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির যৌথ উদ্যোগে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এ ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ মহানগরে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, খুলনায় ড. আব্দুল মঈন খান, কুমিল্লায় নজরুল ইসলাম খান, চট্টগ্রামে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রংপুরে বেগম সেলিমা রহমান, সিলেট বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, বরিশালে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, গাজীপুরে বরকত উল্লাহ বুলু, ফরিদপুরে মোহাম্মদ শাহজাহান, রাজশাহীতে ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও ময়মনসিংহ মহানগরে শামসুজ্জামান দুদু।
তা ছাড়া সকাল ১১টায় ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ পল্টন মোড়ে, ‘১২ দলীয় জোট’ বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কের সামনে, ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ পল্টনের আল-রাজী কমপ্লেক্সের সামনে, ‘সমমনা পেশাজীবী গণতান্ত্রিক জোট’ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ও ‘গণফোরাম-পিপলস পার্টি’ আরামবাগে গণফোরাম চত্বরে সমাবেশ করবে। গণতন্ত্র মঞ্চ তার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সমাবেশ শেষে তারা বিক্ষোভ মিছিল করবে।