
জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি করপোরেশন পরীক্ষার শুরুতেই হোঁচট খেল আওয়ামী লীগ। তাই সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের কাছে নৌকার হারের কারণ খুঁজতে তৎপর ক্ষমতাসীন দলটি। নিজস্ব প্রার্থীর পরাজয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয় নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। একই সঙ্গে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কী বার্তা পেল, তা নিয়েও চলছে জোর আলোচনা। তবে গাজীপুরের সুষ্ঠু ভোটে প্রাপ্তি যোগ হয়েছে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। একটি প্রশংসিত নির্বাচনে সক্ষম হয়েছে তারা।
নির্বাচনী প্রচারকালে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে অতি আত্মবিশ্বাসী দেখালেও বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত ভোটের মাঠে কাউকেই কাছে টানতে পারেননি তিনি। যার ফলে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী হয়েও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে তিনি শেষ পর্যন্ত পেরে উঠতে পারেননি। আজমতের পরাজয়ের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে—মাঠের বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াতের নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং তরুণ, শ্রমিক ও নারী ভোটারদের মন জয় করতে না পারাই আজমতের পরাজয়ের বড় কারণ। ভোটারদের সঙ্গে পর্যাপ্ত যোগাযোগের অভাব, দলীয় কোন্দল এবং স্থানীয় প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের উদাসীনতাকেও আজমত উল্লার পরাজয়ের কারণ হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা।
অন্যদিকে জায়েদা খাতুনের জয়ের কারণ নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ। ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণেই তার বিজয় সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা। ঋণখেলাপির দায়ে জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা বাতিল করা হলেও ছেলের কৌশলে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছেন মা জায়েদা খাতুন। ব্যক্তি জাহাঙ্গীর আলমের ইমেজ ও তার উন্নয়ন কাজ নগরবাসীকে মুগ্ধ করেছে। আর এর প্রতিদান ভোটের মাঠে দিয়েছেন সাধারণ জনগণ।
স্থানীয়রা বলছেন, জাহাঙ্গীর আলম দীর্ঘ তিন বছর এলাকায় অনেক উন্নয়ন করেছেন। রাস্তাঘাটসহ এলাকার চিত্র পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এরপর তাকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে থমকে যায় উন্নয়ন কাজ। নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নাজেহাল হন জাহাঙ্গীর। কিন্তু সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা তার ওপর অটুট থাকায় নির্বাচনের মাঠে প্রভাব ফেলে জায়েদা খাতুনের বিজয়ে। সাধারণ নারী ভোটারদের অকুণ্ঠ সমর্থন, শ্রমিকদের মধ্যে জাহাঙ্গীরের জনপ্রিয়তাও জায়েদা খাতুনের জয়ে ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া নির্বাচনের প্রচারে কয়েক দফা হামলা, বাধা দেওয়ার বিষয়টি মানুষের নজর কেড়েছে। আজমত উল্লা খানের আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা এ সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ফলে মানুষ অনেকটা বিরক্ত হয়েই আজমত উল্লা খানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
তবে নির্বাচনে হারলেও আওয়ামী লীগের অর্জনও আছে। বর্তমান সরকারের অধীনে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া সম্ভব, তা এ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে। দেশ-বিদেশে আস্থা অর্জনের পথে একধাপ এগিয়ে গেল নির্বাচন কমিশন ও সরকার। সেইসঙ্গে দল থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের মায়ের জয়ের মাধ্যমে গাজীপুরের মেয়র পদে অন্য দলের কারও আসীন না হওয়াটাও এক ধরনের বিজয়। গাজীপুরের মতো আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকে জায়েদা খাতুনের জয় আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি কঠিন সতর্কবার্তা বলেও মনে করেন অনেকে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক কালবেলাকে বলেন, বর্তমান সরকার যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে সক্ষম এবং নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, তা এই নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে। গণতন্ত্রের রক্ষক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে আগামী নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে, এটা তারই ইঙ্গিত দেয়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব।
গাজীপুর নির্বাচনে প্রার্থীদের কেউই ভোট জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ না করায় ভোট বর্জন ও কারচুপির অভিযোগের সংস্কৃতির মধ্যে এই ভোট অনন্য উদাহরণ হিসেবে পরিগণিত হবে বলেও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ফলাফল মেনে নিয়ে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খান বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, ফলাফল মেনে নিয়েছি। পরাজয়ের কারণ পর্যালোচনা করে খুঁজে বের করা হবে এবং যিনি বিজয়ী হয়েছেন, তাকে অভিনন্দন জানাই।
অন্যদিকে গাজীপুরের জন্য সবাইকে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন নবনির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুন। এ সময় নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে মাকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা জানান, দলের নেতাদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারাই হারের মূল কারণ। একই সঙ্গে জেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ না করাও আজমত উল্লার পরাজয়ের কারণ। আওয়ামী লীগের যে সমন্বয় কমিটি ছিল, তাদের কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তৃণমূলের নেতারা। তারা বলেন, প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের কেন্দ্রে আজমত উল্লার শোচনীয় হারই প্রমাণ করে, দলের সবাই নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি।
অন্যদিকে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও জনপ্রিয় একজন রাজনীতিক। রাজনীতির মাঠে তিনি অত্যন্ত পারদর্শী এবং কৌশলী। তার প্রমাণ উনি অখ্যাত আর সাধারণ একজন মানুষ, তার নিজের মাকে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী এই গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে জিতিয়ে এনেছেন।
এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি ও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা আ ক ম মোজাম্মেল হক কালবেলাকে বলেন, নেতাকর্মীরা ভেবেছিল খুব সহজেই গাজীপুরে জিতে যাবে, এই প্রবল আত্মবিশ্বাসই নৌকার প্রার্থীর হারের মূল কারণ। তারা মেয়র প্রার্থীর জয় নিশ্চিত ভেবে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছেন। নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার বিএনপি-জামায়াতের গোপন সন্ধিও প্রার্থীর হারের কারণ।