
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এমন কোনো চাপ নেই যেটা শেখ হাসিনাকে দিতে পারে। কারণ, আমার শক্তি একমাত্র জনগণ আর ওপরে আল্লাহ। আমার বাবার আশীর্বাদের হাত মাথায় আছে। কে কী চাপ দিল, এতে আমাদের কিছু আসে-যায় না। জনগণের স্বার্থে, কল্যাণে যেটা করার সেটাই করব।’ গতকাল সোমবার গণভবনে কাতার সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম উল্লেখ না করে কড়া সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘এরকম বহু চাপ ছিল, পদ্মা সেতুর আগে তো কম চাপ দেওয়া হয়নি। কোনো একটা দেশের সেই রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে, তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে টেলিফোনের পর টেলিফোন, কেন? একটা ভদ্রলোক, তাকে একটি ব্যাংকের এমডি পদে রাখতে হবে। এমডি পদে কী মধু, তা তো আমি জানি না। আইন আছে, ৭০ বছর বয়স হয়ে গেছে তার পরও এমডি পদে থাকতে হবে। একটাই সুবিধা, এমডি পদে থাকলে মানি লন্ডারিং করা যায়। পয়সা বানানো যায়, পয়সা মারা যায়, গরিবের রক্ত চুষে খাওয়া যায়। সেই চাপ কিন্তু শেখ হাসিনা সহ্য করে চলে আসছে। তারপর নিজেরা পদ্মা সেতু বানিয়ে দেখালাম। ওই চাপে আমাদের কিছু আসে-যায় না।’
ড. ইউনূসকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ৪০ বিশ্বনেতার খোলা চিঠি, যা ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয়েছে সেটার সমালোচনা করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘এটা বিবৃতি না, একটা অ্যাডভার্টাইজমেন্ট (বিজ্ঞাপন)। যে ৪০ জনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেটা আমাদের বিশেষ একজন ব্যক্তির পক্ষে। এর উত্তর কী দেব জানি না, তবে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আমার প্রশ্নটা হলো, যিনি এত নামিদামি নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত, তার জন্যই ৪০ জনের নাম খয়রাত করে এনে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট দিতে হবে কেন? তাও আবার বিদেশি পত্রিকায়?’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বিজ্ঞাপন কেন দিতে হলো? যে যাই হোক, আমার দেশে কতগুলো আইন আছে। সেই আইন অনুযায়ী সব চলবে এবং সেটা চলে। আমাদের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমরা শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ করি। যারা ট্যাক্স ঠিকমতো দেয়, সেটার আলাদা বিভাগ আছে, ট্যাক্স আদায় করে। কেউ যদি এখন এসব বিষয়ে কোনো রকম আইন ভঙ্গ করে বা শ্রমিকদের কোনো অধিকার কেড়ে নেয়, শ্রম আদালত আছে; সেটা দেখে। এই ক্ষেত্রে তো আমার কোনো কিছু করার নেই সরকারপ্রধান হিসেবে। কাজেই আমাকেই বা কেন এখানে বলা হলো? এর বাইরে আমি আর কী বলব! পদ্মা সেতু কিন্তু করে ফেলেছি। খালি এইটুকু সবাইকে স্মরণ করে দিলাম।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এজেন্সি উন্মুখ হয়ে আছে। ৪০ জনের নামে (ওয়াশিংটন পোস্টের বিজ্ঞাপন) যেটা এসেছে, ওটার পেছনেও কিছু অ্যামবিশন আছে। এতে কোনও সন্দেহ নেই। যাদের ইচ্ছা (ক্ষমতায় যাওয়ার), তারা জনগণের কাছে যাবে। নির্বাচন যাতে অবাধ-সুষ্ঠু হয়, তার জন্য নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় সংশোধনী বা সংস্কার আনা হয়েছে।’
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। রাজনৈতিক স্থতিশীলতা থাকলে উন্নয়ন হয়, সেটা আমরা প্রমাণ করেছি। অন্তত এটুকু দাবি করতে পারি, ’৭৫ সালের পর থেকে যেসব নির্বাচন হয়েছে আর আমরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে নির্বাচন হয়েছে, অন্তত সেই ধরনের চুরি, ভোটকেন্দ্র দখল করা, কারচুপি করার সুযোগ তো এখন নেই। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স আছে, সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলার সুযোগ নেই।’
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইভিএমে ভোটের আয়োজন করতে চেয়েছিলাম। কারণ, সবাই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভোট দেবে, সঙ্গে সঙ্গে ফল পাবে। এখন ঠিক আছে, নির্বাচন কমিশনের ওপর, তারা যতটুকু পারে করবে। পুরোটা করতে পারলে ভালো হতো, অন্তত মানুষ তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারত। একটা আধুনিক পদ্ধতি মানুষ ব্যবহার করতে পারত। সেটা নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা, আমরা এ বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছি।’
বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে দল বেশি লাফায় সে দলের দুই নেতাই হচ্ছে সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা না পারবে ইলেকশন করতে, না পারবে ক্ষমতায় আসতে। বিএনপি নিজের গঠনতন্ত্র নিজেরা ভঙ্গ করছে। কারণ, তাদের গঠনতন্ত্রে আছে সাজাপ্রাপ্ত আসামি দলের নেতা হতে পারে না। এখন সেই সাজাপ্রাপ্ত আসামিকেই দলের নেতা বানিয়ে রেখে দিয়েছে। এখন এ দলের কাছে কী আশা করবেন।’
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা রাজনৈতিক হয় কীভাবে? এই ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ই কিন্তু তারেক জিয়া সাজাপ্রাপ্ত। এমনকি খালেদা জিয়ার মন্ত্রীরাও সাজাপ্রাপ্ত। এরা যদি এটাকে রাজনৈতিক বলে, তাহলে জনগণই এর বিচার করবে। এরা সব সময়ই জনগণের সঙ্গে ভাঁওতাবাজি করে। জনগণের সঙ্গে মোনাফেকি করে। এই অস্ত্র চোরাকারবারি করাই তাদের ব্যবসা। সেটাও তারা রাজনৈতিকভাবে দেখছে।’
সংলাপের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করাই যাদের কাজ, তাদের সঙ্গে সংলাপ করার কিছু নেই। সংলাপ কার সঙ্গে করব? ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমি সংলাপ করেছি, তার রেজাল্টটা কী? নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়া কিছুই করেনি তারা। তারা (বিএনপি) ৩০০ সিটে ৭০০ নমিনেশন দিয়ে টাকা খেয়ে নিজেরাই নিজেদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে তারপর নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’
কেউ কি পারবে বাবার খুনিদের সঙ্গে বৈঠক করতে–প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আল্লাহ ধৈর্য্য দিয়েছেন। ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে তারা। এরপরও সেই খুনিদের সঙ্গে বসেছি দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, নিজের স্বার্থে না। বাংলাদেশের জনগণের জন্য।’
খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, অসুস্থ ও বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় তার (খালেদা জিয়া) ভাই, বোন, বোনের জামাই সবাই এসে আমার কাছে, রেহানার কাছে আকুতি করল তখন তার সাজা স্থগিত করে বাসায় থাকার এবং চিকিৎসার সুযোগ করে দিয়েছি। এটুকু যে করেছি সেটাই যথেষ্ট। এটুকু সহানুভূতি যে পাচ্ছে সেটা আমার কারণে।’
রোজার মাস সামনে রেখে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য সংগ্রহ করে রাখা আছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কিছু আছে মজুদকারী, তারা মজুদ করে রাখার চেষ্টা করে। আর আমাদের কিছু কিছু বিরোধী দল তো আছেই, সব জয়গায় ঝামেলা পাকানোর জন্য একটা চেষ্টা। কথায় কথায় কোনো একটা কথা ছড়ালো, মিথ্যা একটা ধুঁয়া তুলল।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কাতারে সফরত থাকায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যান বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ববি ফুল দিতে গেছে পরিবারের পক্ষ থেকে। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কিংবা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যায়নি।’
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাতার সফর সম্পর্কে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর পাশে সংসদের উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।