
নিত্যপণ্যসহ জীবনযাত্রার আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে নানামুখী চাপে ভোক্তারা। সমাজের সব পেশার মানুষ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। চাল, ডাল, তেল, আটা, ময়দা, ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। দেখা যাচ্ছে, একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে চাহিদা ও মানসম্মত পণ্য পাচ্ছেন না ভোক্তারা। ফলে বেশি টাকা খরচ করে নিম্নমানের পণ্য কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। শাকসবজি থেকে শুরু করে সব পণ্যেই ভেজালের মিশ্রণ বাড়ছে। এতে ভোক্তার স্বাস্থ্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে। বেড়ে যাছে চিকিৎসা ব্যয়। পাশাপাশি পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধে প্রশাসনের উদাসীনতা রয়েই গেছে। এই পরিস্থিতিতে আজ বুধবার দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস।
বাজার পরিস্থিতি ও ভোক্তা অধিকার বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি শামসুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘সংবিধানে বলা আছে, এ দেশের মালিক জনগণ। সরকার জনগণকে প্রাধান্য দেবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ভোক্তার অধিকার রক্ষার বিষয়টি সরকারের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে, আর ভোক্তা বাধ্য হয়ে মাথা পেতে নিচ্ছে।’
জানা গেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ভোগ্যপণ্যের আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করছে। প্রয়োজনে আরও সুবিধা কীভাবে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে। তবে সুবিধা নিলেও সে হিসেবে নিত্যপণ্যের দাম কমছে না। এ নিয়ে সব মহলে সমালোচনা থাকলেও করপোরেট ব্যবসায়ীরা কাউকে পাত্তা দিচ্ছে না। মাত্র কয়েকটি কোম্পানির হাতে নিত্যপণ্যের একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থা থাকায় নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাকে। নিত্যপণ্যের দামের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছেন তারা। চলমান বাজার পরিস্থিতিতে সবাইকে মিতব্যয়ী ও সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। তবে ভোক্তার অভিযোগ নিষ্পত্তি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিং এবং অভিযানে যাচ্ছে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর। লোকবল সংকট থাকায় যথাযথ পর্যবেক্ষণ করতে পারছে না সংস্থাটি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্যের দাম আপাতত কমার সম্ভাবনা কম। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর ও ট্যারিফ কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে আন্তর্জাতিক ইস্যু কাজ করছে। তবে বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। তারপরও দাম বেড়েছে বা বাড়ছে। এর মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে পণ্যের শুল্ক কমিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে, যদিও তার সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না।
এদিকে, তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ছিল ৬ টাকা ৫০ পয়সা, ২০১৭ সালে ৬ টাকা ৮৫ পয়সা, ২০২০ সালে ছিল ৭ টাকা ১৩ পয়সা পর্যন্ত। বিদ্যুতের নতুন দাম (৮ টাকা ২৫ পয়সা) বাসাবাড়িতে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারে মাসিক খরচ বাড়বে ১৮২ টাকা। আর যাদের ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহার হয়, তাদের বাড়বে ২৮৫ টাকা। ফলে নগরীর বাসাবাড়ির পানির ব্যবহার থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়বে।
এমনিতেই কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষ। তার ওপর বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অত্যাবশ্যক সেবা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখা দায় হয়ে পড়ছে। দেশ-বিদেশে অর্থনৈতিক সংকট অব্যাহত থাকায় বর্ধিত মূল্যের কারণে ফেব্রুয়ারিতে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্যমতে, এ মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি খাদ্য ও অখাদ্য উভয় ক্ষেত্রেই গ্রামের মানুষ মূল্যস্ফীতির কবলে বেশি পড়েছে। আলোচ্য মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৭৮ শতাংশে। যা জানুয়ারি মাসে ছিল ৮.৫৭ শতাংশ। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি। শহরের মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং গ্রামে ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ।
সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্যে ছিল ৮ দশমিক ১৯ এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ওই সময় নগরীতে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৯৮ এবং অখাদ্য পণ্যে ছিল ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারের মূল্যস্ফীতির হিসাব কাগজে কলমে। বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল নেই। বাস্তবে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি।’
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়েনি—এমন একটি পণ্যও নেই। এ সময়ে সাধারণ মানুষের আয় রোজগার না বাড়লেও বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। অনেকে চাহিদা কাটছাঁট করে জীবনযাপন করছেন। পরিবারের প্রয়োজন কমিয়ে সন্তানের পড়ালেখার খরচ মেটাচ্ছেন। আবার অনেকে ব্যয় কমাতে শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছেন, আবার গ্রাম থেকে শহরে আসছেন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিদপ্তর ১ জুলাই ২০২২ থেকে ২৮ ফেব্রয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত মোট ১৫ হাজার ৬৮৮টি অভিযোগ পেয়েছে, নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ হাজার ৫৬৮টির, বাকি আছে ৫ হাজার ১২০টি। একই সময়ে বাজার অভিযান পরিচালনা করেছে ৮ হাজার ১৭৫টি, দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৭ হাজার ৭০০টি, আদায় করা জরিমানার পরিমাণ ১ কোটি ৪১ লাখ ৪০ হাজার ৪০০ টাকা, অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৭২টি, অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে আদায় করা জরিমানার পরিমাণ ৫৬ লাখ, ৮৪ হাজার ৬০০ টাকা।
এদিকে, বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, এই সময়ে সবার সাশ্রয়ী হওয়া দরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারেও সাশ্রয়ী হতে হবে। তা না হলে আমাদের অনেক বেশি ভুগতে হবে।
তিনি বলেন, ভোক্তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে ভোক্তার অধিকার রক্ষায় যে আইন আছে, সে সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা গেলে সুফল পাওয়া যাবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, সার্বিকভাবে ভোক্তাদের যে অধিকার, যেমন ন্যায্যমূল্য ও ভেজালমুক্ত পণ্য পাওয়া; বিশেষ করে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য যাতে বাজারে ডুকতে না পারে এবং ওজনে কম দিতে না পারে, সেজন্য ভোক্তা অধিকার আইনের প্রয়োগে ভোক্তা অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। আমরা ভোক্তাদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য অনেক কাজ করছি।