রাজন ভট্টাচার্য
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৩, ০৯:১৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাল ছাড়পত্রে নির্মাণ হচ্ছে নৌ-পরিবহনের বহুতল ভবন

জাল ছাড়পত্রে নির্মাণ হচ্ছে নৌ-পরিবহনের বহুতল ভবন

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের ১১ তলা নিজস্ব ভবন। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে এর ৭০ শতাংশ কাজ। সম্প্রতি জানা গেছে, ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র জাল করে নির্মাণ করা হচ্ছে ভবনটি। মানা হচ্ছে না দরপত্রের শর্তও। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবন নির্মাণে তাদের যেসব কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে, তার সবকটিই জাল। এই ভবনের জন্য কোনো ছাড়পত্র দেয়নি তারা।

প্রকল্প শুরুর ৯ বছরের মাথায় অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব অনিয়মের চিত্র। এদিকে এর দায় নিতে নারাজ প্রকল্প কর্মকর্তা। তিনি বলছেন, চুক্তি অনুযায়ী সব নিয়ম মেনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের কথা। তারা ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র জমা না দিলে কোনো বিল পরিশোধ করা হবে না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভবনটি নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতার পেছনে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিই মূলত দায়ী। প্রকল্পের সময়সীমা ও ব্যয় বৃদ্ধি করে অর্থ লোপাটের উদ্দেশ্যেই ধীরগতিতে নির্মাণকাজ চালানো হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও ঠিকাদারসহ নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দিকেই এ অভিযোগের তীর।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিজেও এ কথা স্বীকার করেছেন। তার দাবি, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ পিডিকে প্রত্যাহার করে নতুন পিডি নিয়োগের জন্য নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন তিনি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে পিডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের হাতে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ করতে পারি। সর্বোচ্চ মামলা করা যায়; কিন্তু অফিসার কম থাকায় তা সম্ভব হয় না। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেও কোনো লাভ হয় না।

নৌ খাতের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার স্বার্থে ২০১৪ সালে গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম (জিএমডিএসএস) নামে নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় নৌ অধিদপ্তরকে। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ২৮৯ কোটি টাকার ৭০ শতাংশ এসেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণসহায়তা থেকে। আর বাকি ৩০ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিলের।

তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের বাস্তবায়নের শেষ সময় ছিল ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। পরে দুই দফা প্রকল্পটির কাজের পরিধি বাড়িয়ে এর নামকরণ হয় ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্ট্রিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’। একই সঙ্গে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ৭৭৯ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০২৪ সালের ৩০ জুন চূড়ান্ত করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন অবকাঠামো স্থাপনের পাশাপাশি এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের জন্য একটি ১১তলা ভবন নির্মাণ। ভবনটির নির্মাণকাল ছিল ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পরে সময়সীমা বাড়িয়ে এর ২০২৪ সালের ৩০ জুন করা হয়।

এ প্রকল্পের মূল ঠিকাদার কোরিয়ান কোম্পানি এলজি সামিহ কনসোর্টিয়াম। তবে কোরিয়ান ঠিকাদার এ কাজে বাগদাদ কনস্ট্রাকশানসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সহ-ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ করেছে। তারাই ভবন নির্মাণসহ ইন্টেরিয়র ও ডেকোরেশনের কাজ করছে। এর মধ্যে কাজ শেষ করেও বিল না পাওয়ায় একটি সহ-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একজন আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, নির্মাণাধীন ভবনটির নিচতলায় ফায়ার ফিটিংসের যে কাজ করা হয়েছে, তাতে নানা অসংগতি রয়েছে। ভবনের বেজমেন্টে পাওয়ার সাব-স্টেশন ও জেনারেটর হাউস পাশাপাশি স্থাপন করায় ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছিল। পরে অতিরিক্ত প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থাপনা দুটি আলাদা করা হয়। বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার কাজও একেবারেই এলোমেলো। একই কাজ একাধিকবার করে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়তলার সিলিংয়ে কিছু এয়ারকন্ডিশনের (এসি) তার এলোমেলো থাকলেও এ পর্যন্ত একটিও এসি লাগানো হয়নি। যেসব ফ্লোরের কাজ শেষ করার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোও অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক দ্রুত কাজ শেষ করতে নিজের মতো করে ঠিকাদার নিয়োগ করেছেন। প্রকল্প পরিচালক ও মহাপরিচালকের ধাক্কাধাক্কি ও পাল্টাপাল্টি অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে ভবনের বাকি নির্মাণকাজ কবে শেষ হবে, তাই এখন অনিশ্চিত।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে কাকতালীয়ভাবে সেখানে উপস্থিত নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর নিজামুল হক নিজেই তৃতীয়তলায় নিয়ে ঘুরে সেখানকার চিত্র দেখান। ভবনটির ৭ তলা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন তলায় অধিকাংশ দরজা প্লাস্টিকের তৈরি। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, কাঠের তৈরি দরজা লাগানোর কথা। এ ছাড়া কয়েকটি তলার মেঝেতে টাইলস বসানো হয়নি। ওয়াশরুমে স্থাপন করা বেসিন, কমোড ও অন্যান্য ফিটিংসও নিম্নমানের। সিঁড়িও হয়নি মানসম্মত।

অনুসন্ধান বলছে, সম্প্রতি ভবনের ফায়ার সেফটি প্ল্যান অনুমোদন যাচাই করতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে চিঠি দেন কমডোর নিজামুল হক। মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে তদন্ত কমটি গঠন করে। সেই কমিটি প্রকল্পে নানা অনিয়ম দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বলে জানা গেছে।

গত ৭ মে নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সেই চিঠির জবাব দেন ফয়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটিনেন্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। চিঠিতে তিনি জানান, প্রকল্পের আওতায় ঢাকার আগারগাঁওয়ের ১১তলা নির্মাণাধীন ভবনের জন্য এ্যাপগি কনসালটেন্সি লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানের ফায়ার সেফটি প্ল্যানের ড্রয়িং দাখিল করে ঠিকাদার সামহি কনস্ট্রাকশন। সেটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে পাঠানোর পর দেখা গেছে, প্ল্যানটিতে তাদের লগো ও অনুমোদন মুদ্রণ করা থাকলেও সিল ও স্বাক্ষর সেখানে নেই। অর্থাৎ, তারা প্ল্যানটির অনুমোদন দেননি।

প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আবু সৈয়দ মুহম্মদ দেলোয়ার রহমান বলেন, কোরিয়ান কোম্পানি এ প্রকল্পের কাজ করছে। চুক্তি অনুযায়ী, ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদনসহ সব কার্যক্রম চূড়ান্ত করার কথা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। তারা এক্ষেত্রে চুক্তির বরখেলাপ করেছে। জাল কাগজপত্র দেখিয়ে দিনের পর দিন কাজ করেছে। এর দায়ভার একেবারেই তাদের। তারা এখনো ভবন বুঝিয়ে দেয়নি।

তিনি আরও জানান, ভবনটি রাজউকের অনুমোদন নিয়ে ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-বিএনবিসি মেনে নির্মাণ করা হচ্ছে। বিএনবিসির একটি অংশ হলো, ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেওয়া। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ছাড়া ভবন বুঝিয়ে দিলে আমরা নেব না। এমনকি বিলও পরিশোধ করা হবে না। তবে ভবন নির্মাণ শুরুর নয় বছর পর কেন এই ত্রুটি ধরা পড়ল এ ব্যাপারে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

তবে উপপ্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ফরহাদ জলিল বিপ্লব বলছেন, ১১তলা ভবন নির্মাণে কোনো অনিয়ম হয়নি। দরপত্রের শর্ত এবং এ-সংক্রান্ত সরকারি বিধিবিধান মেনেই সবকিছু করা হয়েছে।

এদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি-সামহি কনসোর্টিয়ামের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে কেউ সাড়া দেননি। এমনকি নির্মাণাধীন ভবনে গিয়েও প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি কাউকে পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর নিজামুল হক বলেন, আমাকে না জানিয়ে এবং কোনো অনুমোদন না নিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে। এজন্য পিডি দেলোয়ার রহমান ও কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামিহকে সরাসরি দায়ী করেন তিনি।

মহাপরিচালক আরও বলেন, কাজ দ্রুত শেষ না হওয়ায় আমি নিজে আরেকটি সহ-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে কাজ করিয়েছি। এতে অনেক কাজ এগিয়েছে। তবে এই প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোনো বিল দিচ্ছে না। তাহলে আপনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে কমডোর নিজামুল হক বলেন, পিডি ও ঠিকাদারের অনিয়ম ও দুর্নীতি আমার নজরে আসার পর এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও বলেছি। পিডিকে প্রত্যাহার করে নতুন পিডি নিয়োগের জন্য চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছি।

যদিও গত সোমবার নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বদলি করা হয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২৫ এপ্রিল : নামাজের সময়সূচি

সাতক্ষীরায় ৬০ বছর পর ৩৩ বিঘা সরকারি জমি উদ্ধার

দাবদাহে ঝরছে লিচুর মুকুল, দুশ্চিন্তায় দিনাজপুরে চাষিরা

তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে কুমিল্লায় গাছ লাগাচ্ছে ছাত্রলীগ

ফরিদপুরের ঘটনা আদিম যুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে : আব্দুর রহমান

২৪ ঘণ্টায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ২ কর্মী খুন

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে বিপদে জর্ডান

‘হারল্যান স্টোর’ মিরপুর-১০ শাখার উদ্বোধন করলেন নুসরাত ফারিয়া

ভোলায় হিটস্ট্রোকে যুবকের মৃত্যু

ফিতরা জাকাতের টাকা চেয়ে খুদে বার্তায় প্রতারণার ফাঁদ

১০

এক সপ্তাহের মধ্যেই পরমানু বোমার ইউরেনিয়াম পাবে ইরান!

১১

ননদের বিয়েতে টিভি উপহার দিতে চাওয়ায় স্বামীকে হত্যা

১২

মেঘনা নদীতে ভেসে এলো খণ্ডিত পা

১৩

ঈশ্বরদীতে হিটস্ট্রোকে স্বর্ণকারের মৃত্যু

১৪

সুচিত্রা সেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মাইক’ পুরস্কৃত

১৫

নারী চিকিৎসকের সেবা নেওয়া রোগীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি : গবেষণা

১৬

সরকারকে পরাজয় বরণ করতেই হবে : মির্জা ফখরুল

১৭

দেশে ফিরে কারাগারের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন তারা

১৮

হরমোনজনিত সমস্যায় দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ, জানেন না ৯০ শতাংশই

১৯

আনু মুহাম্মদের পায়ে আবারও অস্ত্রোপচার করা হবে

২০
*/ ?>
X