মাওলানা মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২৩, ০৮:৪৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইবাদত ও রহমতের মাস রমজান

ইবাদত ও রহমতের মাস রমজান

আজ থেকে পবিত্র মাহে রমজানের শুরু। জীবনের পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত ও পবিত্র করার এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ। রমজানকে বলা হয় ইবাদতের বসন্ত মাস। এ মাসে আসমান থেকে বর্ষিত হতে থাকে রহমত, বরকত ও নাজাতের বারিধারা। বসন্তের আগমনের আগেই যেমন প্রকৃতি নতুন সাজে সজ্জিত হতে থাকে, তেমনি

মুমিনও রমজানের আগমন মুহূর্তে নিজেকে প্রস্তুত করে। রমজান আগমনের পূর্বমুহূর্তে রাসুল (সা.) রমজানের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিতেন। সাহাবিদের নিয়ে মজলিশ করতেন।

রমজানের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য, করণীয় ও বর্জনীয় বোঝাতেন। রমজান যেহেতু মুসলমানদের জন্য এক আলোকবর্তিকা নিয়ে হাজির হয়, তাই সবার কর্তব্য রমজানের যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবন করা। নিজের জীবন আমলের মাধ্যমে সুন্দর ও সমৃদ্ধি করা। যাপিত জীবনের সব পাপ-পঙ্কিলতা ধুয়ে-মুছে আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়ার চেষ্টা করা। আল্লাহতায়ালা এ মাসকে হেদায়াতের মাস বানিয়েছেন। রহমতের মাস উল্লেখ করেছেন।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘রমজান মাস, যে মাসে বিশ্বমানবের জন্য পথ প্রদর্শন এবং সুপথের উজ্জ্বল নিদর্শন এবং হক ও বাতিলের প্রভেদকারী কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসে (নিজ আবাসে) উপস্থিত থাকে সে যেন সিয়াম পালন করে এবং যে ব্যক্তি পীড়িত অথবা প্রবাসী, তার জন্য অন্য কোনোদিন হতে গণনা করবে; তোমাদের পক্ষে যা সহজসাধ্য আল্লাহ তাই ইচ্ছা করেন ও তোমাদের পক্ষে যা দুঃসাধ্য তা ইচ্ছা করেন না এবং যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করে নিতে পারো। তোমাদের যে সুপথ দেখিয়েছেন তজ্জন্য তোমরা আল্লাহকে মহিমান্বিত করো এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)।

রোজা পালনকারীদের সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতের রাইয়ান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কেয়ামতের দিন সওম পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে, সওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে।’ (বুখারি : ১৮৯৬)

রমজান মাস যেহেতু আমলের মাস, তাই এ মাসের মুখ্য বিষয় হওয়া দরকার আমল। কীভাবে আমলের পাল্লা ভারী হবে, পরকালে নাজাত পাওয়া যাবে—সেই প্রচেষ্টায় রমজান অতিবাহিত করাই হবে একজন মুমিনের আসল কাজ। রমজানের শুরুতেই একটা খসড়া তৈরি করা যেতে পারে—কোন আমল কখন করবেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজগুলো ঠিকমতো জামাতের সঙ্গে আদায় করার পাশাপাশি কয় খতম কোরআন তেলাওয়াত করবেন, কত হাজার কালেমা, জিকির আজকার করবেন—তার একটা তালিকা করা। বিশেষ করে রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা। যারা কোরআন তেলাওয়াত জানেন না অথবা শুদ্ধ করে তেলাওয়াত করতে পারেন না, তারা এই রমজানে কোরআন শেখার কাজটা শেষ করতে পারেন। প্রতিদিন তারাবিগুলো ঠিকমতো আদায় করা। নফল নামাজ পড়ার জন্য দৈনন্দিন একটা টার্গেট ঠিক করা।

রাতের শেষ ভাগ আল্লাহর রাব্বুল আলামিন বিশেষভাবে দোয়া কবুল করেন। এ সময় গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে তাহাজ্জুদের নামাজ। প্রতিদিন যদি তাহাজ্জুদের সালাত চালিয়ে যেতে পারি তাহলে রোজার মাসে সেহরির জন্য জেগে ওঠার জন্য ইনশাআল্লাহ কোনো যন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হবে না। আর তাহাজ্জুদ হচ্ছে এমন এক মুহূর্ত যখন দোয়া কবুলের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ প্রতি রাতের শেষ প্রহরে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। তিনি তখন বলেন, ‘আছো কি কোনো আহ্বানকারী, আমি তোমার ডাকে সাড়া দেব। কোনো প্রার্থনাকারী কি আছো, আমি তোমাকে যা চাও তা দেব। কেউ কি ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব।’ (মুসলিম : ৭৫৮)। আর তাহাজ্জুদ আদায়ের ফলে ফজর কাজা হওয়ার সুযোগ অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়, যদি আমরা তাহাজ্জুদ আদায় করে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাসকে ত্যাগ করতে পারি।

রমজানে অনর্থক কথাবার্তা না বলে আল্লাহর জিকিরে কাটানো উচিত। জিকির বা আল্লাহর স্মরণ মানুষের মনকে তৃপ্ত রাখে। প্রতিমুহূর্তে আল্লাহকে স্মরণ করা চাই, যাকে আরবিতে জিকির বলে। পবিত্র কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো।’ (সুরা আহজাব : ৪১)। তা ছাড়া নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার রবের জিকির (স্মরণ) করে আর যে ব্যক্তি তার রবের জিকির করে না—তারা যেন জীবিত আর মৃত।’ (বুখারি : ৬৪০৭; মুসলিম : ৭৭৯)। তাই সকাল-সন্ধ্যায় জিকিরের পাশাপাশি নিজে থেকে সময় হলেই অতিরিক্ত কিছু জিকির আমরা মুখে সর্বদা জারি রাখতে পারি। ইসলামের দৃষ্টিতে জিকিরের ফজিলত অনেক। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইস্তেগফার পাঠ করা, যখন-তখন সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার এবং কলেমার জিকির পাঠ বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। এতে রমজানের সময় অবসর সময়ে অহেতুক কাজকর্ম থেকে মন ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ।

রমজানে আমরা বেশি বেশি দান করার নিয়ত করতে পারি। এখন থেকেই রমজান মাসে বেশি বেশি সদকার পরিকল্পনা করে নেওয়া উচিত। যেহেতু এ অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত মানুষের পরিমাণ বেশি, তাই এখন থেকেই অল্প অল্প করে কিছু টাকা রমজান মাসে সদকা করার উদ্দেশ্যে জমিয়ে রাখলে ভালো হবে। কেউ চাইলে এখন থেকে সদকার অভ্যাস শুরু করে দিতে পারে। এতে ইনশাআল্লাহ অন্তরের কার্পণ্যবোধ কেটে যাবে। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যারা আল্লাহর প্রতি ইমান আনে ও সৎকাজ করে এবং নামাজ প্রতিষ্ঠিত করে ও জাকাত দেয়, তারা আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পাবে। ভবিষ্যতের জন্য তাদের কোনো আশঙ্কা নেই এবং (অতীতের জন্যও) তারা দুঃখিত বা অনুতপ্ত হবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৭)। সদকা অসহায় মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটায়। আর অসহায় মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে অহেতুক অহংকার করার অভ্যাস ঠিক হয়ে যাবে।

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। চাইলেও এটাকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলা সম্ভব হয় না। তবে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখতে পারি। কারণ ইবাদতের প্রতি অনীহা সৃষ্টিতে এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। অহেতুক যেসব সাইটে আমরা অ্যাড আছি সেগুলোকে এখনই আনফলো এবং ব্লক করে দিতে হবে, অশ্লীলতা ছড়ায় এমন সাইটগুলো থেকে যতটা দ্রুত সম্ভব সরে আসতে হবে। কারণ পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা অশ্লীলতার কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটি প্রকাশ্য অশ্লীলতা ও অত্যন্ত মন্দ পথ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩২)। সেলফ রিমাইন্ডারের জন্য কিছু ভালো ভালো সাইটে সংযুক্ত থাকা যেতে পারে, তাও যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে।

ঘরোয়া কাজেও সহযোগিতা করা দরকার। পরিবারের কাজে সবার সমান অংশগ্রহণ থাকা ভালো। ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করা নবীজীর (সা.) সুন্নত। এটা যেমন অলসতা দূর করে, তেমনি পারিবারিক বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে। রমজান মাসে পুরো দিন না খেয়ে থাকার কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই শারীরিক দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন নিজে বসে না থেকে সবার সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করলে একে যেমন শারীরিকভাবে সবাই কম দুর্বল হবে, তেমনি সবার হাতেই বাড়তি কিছুটা সময় চলে আসবে ইবাদত করার জন্য। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পারিবারিক কাজে অংশ নিতেন। ব্যক্তিজীবনে মহানবী (সা.) একজন সাধারণ মানুষের মতো ছিলেন। অবসর সময়ে তিনি পারিবারিক কাজে অংশগ্রহণ করতেন। নিজের কাজ নিজেই সেরে নিতেন। আসওয়াদ (রা.) বলেন, আমি একবার আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসুল (সা.) ঘরে কী কাজ করতেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘তিনি ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতেন, অর্থাৎ গৃহস্থালি কাজে পরিবার-পরিজনের সহযোগিতায় থাকতেন। যখন নামাজের সময় হতো, তখন নামাজে চলে যেতেন।’ (বুখারি : ৬৭৬)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইসরায়েলি বিমান হামলা, নিহত ৩৬ সেনা

জাভির পর কে হবেন বার্সা কোচ!

১ ঘণ্টায় শেষ রেলের ১৪ হাজার টিকিট

বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা

গুগলে ৪ বিষয়ে এড়িয়ে না গেলে বিপদ

নাটোরে স্কুলছাত্রের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার, ৪ বন্ধু আটক

নওগাঁয় সাড়া ফেলেছে নতুন জাতের মুরগি ‘বাউ চিকেন’

টাঙ্গাইলে সংঘর্ষের পর আগুনে পুড়ল লরি ও কাভার্ডভ্যান

দৌলতদিয়ায় ফেরি পারাপারে অনিয়মের অভিযোগ

৫ বিদেশি খেলিয়ে আলোচনায় রাজস্থান

১০

দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস খাদে পড়ে ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত

১১

সেভ দ্য চিলড্রেনে নিয়োগ, নেই বয়সসীমা

১২

ক্রেতা সংকটে তরমুজ বিক্রেতারা

১৩

কুমিল্লার হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে সেই লিফট সিলগালা

১৪

সাভারে পিনিক রাব্বী গ্রুপের অন্যতম সদস্য রাজিব গ্রেপ্তার

১৫

নন্দীগ্রাম প্রেসক্লাবের নতুন সভাপতি তুহিন, সম্পাদক হানিফ

১৬

মাইকে আজানের অনুমতি পেল ইতালির যে শহর

১৭

ছুটির দিনেও ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর

১৮

আজ পাওয়া যাচ্ছে ৮ এপ্রিলের ট্রেনের টিকিট

১৯

ঈদকে কেন্দ্র করে জালনোটের কারবার, গ্রেপ্তার ৩

২০
*/ ?>
X