
আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে বিএনপি। দলীয় এই সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে কেউ অংশ নিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারিও দেয় দলটি। এরপরও নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে আগ্রহী নেতাদের দলের পক্ষ থেকে বোঝানোও হয়েছে কিংবা হচ্ছে। দলীয় প্রতীকে মেয়র পদে এই সিদ্ধান্ত মানলেও কাউন্সিলর পদে ভোট থেকে আগ্রহী নেতাদের সরানো যাচ্ছে না। তবে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলন সামনে রেখে সংগঠনে শৃঙ্খলা রক্ষায় এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে বিএনপির হাইকমান্ড। সেটি মেয়র কিংবা কাউন্সিলর যে পদেই হোক না কেন।
তাই গাজীপুর সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে অংশ নেওয়া মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ২৯ নেতাকে এরই মধ্যে দল থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অন্য সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়া নেতাদের কঠোর বার্তা দিয়েছে দল। বাকি চার সিটিতেও যারা চূড়ান্তভাবে ভোটের মাঠে থাকবেন, তাদেরও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। এরপরও বাকি চার সিটিতে কাউন্সিলর পদে ভোট করতে বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ ছাড়া দলের দুই শতাধিক নেতা এরই মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে রয়েছেন, অনেকে শেষ মুহূর্তে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করবেন।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, দল যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা কখনোই অংশগ্রহণ করব না। সে ক্ষেত্রে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কিংবা দলের সদস্য হিসেবে যারা সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন, তারা ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তা করে দলের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করেছেন। সুতরাং এটা সম্পূর্ণরূপে শৃঙ্খলাবিরোধী। তারপরও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। এরপরও যখন তারা থামেননি, তখন দল তাদের বহিষ্কার করেছে। অন্য সিটিগুলোতে দলের যারা প্রার্থী হয়েছেন বা হতে চান, এই ব্যবস্থা তাদের জন্য একটি কড়া বার্তা।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সবশেষ নির্বাচনে পাঁচটির মধ্যে শুধু সিলেট সিটিতে বিএনপির মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। তখন গাজীপুরে হাসান উদ্দিন সরকার, খুলনায় নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী, রাজশাহীতে মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এবং বরিশালে মজিবর রহমান সরোয়ার বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। তখন কাউন্সিলর পদে বিএনপির স্থানীয় নেতারা নির্বাচন করেছিলেন এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা কাউন্সিলরও নির্বাচিত হন। তবে পরে বিএনপির কাউন্সিলরদের মধ্য থেকে অনেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
তপশিল অনুযায়ী, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে ২৫ মে। খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ১৬ মে, বাছাই ১৮ মে, ২৫ মের মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে এবং ভোট গ্রহণ হবে ১২ জুন। রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২৩ মে পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে, বাছাই ২৫ মে ও ১ জুনের মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে আর ভোট গ্রহণ হবে ২১ জুন।
জানা গেছে, গাজীপুর সিটিতে হাসান উদ্দিন সরকার এবার ভোট না করলেও অবস্থান ধরে রাখতে কৌশলের অংশ হিসেবে তার ভাতিজা সরকার শাহ নূর ইসলাম রনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। রনির বাবা নুরুল ইসলাম সরকার কেন্দ্রীয় যুবদলের নেতা ছিলেন। রনি টঙ্গী থানা বিএনপির ৩ নম্বর সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া গাজীপুর মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি পদেও প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। তবে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ৩০ নেতা মনোনয়নপত্র তোলেন। দল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার পর তাদের মধ্যে মাত্র একজন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। পরে গত ১৬ মে বাকি ২৯ জনকে আজীবন বহিষ্কার করে দল। এদিকে সরকার শাহ নূর ইসলাম রনি নির্বাচনে অংশ নিলেও কোনো পদে না থাকায় দলের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বরিশালে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে মজিবুর রহমান সরোয়ার ভোট করছেন না। তবে বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রূপম স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন। তিনি এরই মধ্যে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। আহসান হাবিব কামাল বরিশাল মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক মৎস্যবিষয়ক সম্পাদক। এদিকে বরিশালের অন্তত ২৪টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে বিএনপির বর্তমান এবং সাবেক ২৫ নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন আছেন বর্তমান মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং পাঁচজন সদস্য। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ১০টি পদের মধ্যে সাতটিতে প্রার্থী হয়েছেন দলের বর্তমান ও সাবেক পদধারী নেতারা।
রাজশাহী সিটিতে গতবারের বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলসহ দলের কেউ এখন পর্যন্ত মনোনয়নপত্র তোলেননি, কেউ তুলবেনও না। বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য নাদিম মোস্তফার ছোট ভাই রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সাহিদ হাসান মেয়র পদে প্রথমে নির্বাচন করার চিন্তাভাবনা করলেও দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে তিনি মনোনয়নপত্র তুলছেন না।
সাহিদ হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা সিটি নির্বাচন নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি মনে করি, আসন্ন রাসিক নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে না। নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। তাই আসন্ন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয় থেকে সরে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগ সরকারের পাতানো ফাঁদে পা দেব না।’
এদিকে রাজশাহীতে কাউন্সিলর পদে এখন পর্যন্ত পাঁচজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, যারা বিএনপির সমর্থক পর্যায়ের। যাদের দলীয় পদপদবি আছে, তারা এখনো কেউ মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি। তবে বিএনপির পদধারী ১০ নেতা জানিয়েছেন, কাউন্সিলর পদে তারা এখনো কেউ মনোনয়নপত্র জমা না দিলেও ২৩ তারিখের মধ্যেই জমা দেবেন।
সিলেটের বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আজ শনিবার তার অবস্থান পরিষ্কার করবেন। জানা গেছে, বহিষ্কারের খড়্গ থাকা এবং দলের পক্ষ থেকে যথাযথ মূল্যায়নের আশ্বাসে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেবেন। মেয়রের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, দাবি আদায় সাপেক্ষে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে সিলেট-৪ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চান আরিফ। এ ছাড়া দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতেও পদোন্নতি চান তিনি। সে ক্ষেত্রে যুগ্ম মহাসচিব, উপদেষ্টা কিংবা ভাইস চেয়ারম্যান হতে চান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদে থাকা আরিফ।
তবে দলের পক্ষ থেকে কঠোর নিদের্শনা থাকলেও ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের। সিসিকের সাধারণ ৪২টি ও সংরক্ষিত ১৪টির সব কটিতেই চার থেকে পাঁচজন করে বিএনপির প্রার্থী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাউন্সিলর পদে বিএনপির দেড় শতাধিক নেতা এরই মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে রয়েছেন। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, এই সংখ্যা বাড়ছে। মনোনয়নপত্র দাখিলের পর জানা যাবে বিএনপির কতজন প্রার্থী কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আগ্রহী প্রার্থীদের অধিকাংশই বিএনপির সাবেক নেতা, সমর্থক বা বর্তমান কাউন্সিলর। এর মধ্যে জেলা ছাত্রদলের সভাপতির নামও রয়েছে। এ অবস্থায় আগ্রহী প্রার্থীদের কঠোর বার্তা দিয়েছে দলটি। কাউন্সিলর পদে প্রার্থী না হতে সিলেটের ৩২ নেতাকে মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অবশ্য গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডে টানা চারবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। তিনি মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক।
সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, যে কেউ দলের স্বার্থ না দেখে ও সিদ্ধান্ত অমান্য করলে কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুলনা সিটিতে মেয়র পদে বিএনপির কেউ মনোনয়নপত্র তোলেননি। গত নির্বাচনে নজরুল ইসলাম মঞ্জু ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করলেও দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে এবার তিনি ভোট করছেন না। যদিও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে কাউন্সিলর পদে দলটির পদধারী দুজন নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ ছাড়া জামায়াতের পাঁচজন প্রার্থী হয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে ৩১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৯টিতে বিএনপিসমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেন। এ ছাড়া ১০ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের মধ্যে বিএনপির একজন ছিলেন। বিএনপির এই ১০ কাউন্সিলরের মধ্য ছয়জন আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন।