কালবেলা প্রতিবেদক, ঢাকা ও মাদারীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৩, ০৯:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নিমিষে শেষ স্বপ্নগুলো

নিমিষে শেষ স্বপ্নগুলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুরভী আলম সুইটি কয়েকদিন আগে গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের পাঁচুরিয়া এলাকায় এসেছিলেন। গতকাল রোববার সকালে বাবা মো. মাসুদ আলমের সঙ্গে দুর্ঘটনায় পড়া ইমাদ পরিবহনের বাসে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। কিন্তু প্রিয় ক্যাম্পাসে আর ফেরা হলো না ওই শিক্ষার্থীর। সড়কেই হারিয়েছেন প্রাণ। চোখের সামনে মেয়েকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় আহত বাবা মাসুদ হোসেন। ছুটি শেষে ঢাকা হয়ে ময়মনসিংহে ফিরছিলেন গোপালগঞ্জ সদরের ব্যাংকপাড়ার বাসিন্দা আফসানা মিমি। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তিনিও। আফসানা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্রী ছিলেন।

সিঙ্গাপুরে গিয়ে সংসারের সচ্ছলতা ফেরানোর ইচ্ছে ছিল মোস্তাক আহমেদের। এজন্য তিনি ওই বাসটিতে করে ঢাকায় আসছিলেন ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট’ দিতে। পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে সড়কেই প্রাণ হারিয়েছেন তিনি।

গতকাল রোববার সকালে খুলনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা ‘ইমাদ পরিবহনের’ বাসটি মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে’র পাশের খাদে ছিটকে ভয়ংকর দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে ঢাবি ছাত্রী সুইটি ও বিদেশগামী মোস্তাকসহ ১৯ জন প্রাণ হারান। নিহতদের মধ্যে বাসটির চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারও রয়েছেন। ওই ঘটনায় অন্তত ৩০ জন আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ঘটনা তদন্তে মাদারীপুর জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

ওই বাসে থাকা যাত্রীদের কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতে শুক্র-শনিবারের ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় কর্মস্থলে আসছিলেন, কেউ বেড়াতে। রাজধানীতে আসার একেক জনের উদ্দেশ্য ছিল একেক ধরনের। কিন্তু পথেই এমন ভয়ংকরভাবে সড়কের খাদে বাসটি ছিটকে পড়ে স্বপ্ন চুরমার হয়েছে সবার। এখন গোপালগঞ্জ আর খুলনার বিভিন্ন এলাকায় কান্নার রোল। ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটলেও দেশের একমাত্র এই এক্সপ্রেসওয়ে এলাকায় এত ভয়ংকর দুর্ঘটনা এর আগে হয়নি কখনো।

পুলিশ আর বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের কয়েকজন বলছেন, বাসটি চলছিল অতি দ্রুতগতিতে। পথে পথেই চালক উল্টাপাল্টা চালাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে সামনে একটি চাকা ফেটে সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের পাশের রেলিং ভেঙে খাদে পড়ে যায়। আসনের বাইরেও দাঁড়ানো যাত্রী ছিলেন তাতে। বাসটি সামনে থেকে অর্ধেক পর্যন্ত দুমড়েমুচড়ে গেছে।

ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, দুর্ঘটনায় পড়া ইমাদ পরিবহনের বাসটি চলাচলেরই অনুমোদন ছিল না। ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাতে এই বাসটিই গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে সোনাশুর দুর্ঘটনায় পড়েছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দিলে পুলিশ কর্মকর্তাসহ চারজন মারা যান তখন, আহত হন আরও ১৫ জন। এরপর সেটির চলাচল স্থগিত করা হয়। তা ছাড়া গত জানুয়ারিতে এর ফিটনেস সনদের মেয়াদও শেষ হয়েছে।

বিআরটি সূত্র জানায়, দুর্ঘটনায় পড়া বাসটি তৈরি হয়েছে ২০১৭ সালে। এর রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয় পরের বছরের শুরুর দিকে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পান্থপথ শাখা ও ইমাদ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির যৌথ নামে রয়েছে এটি। কাগজপত্রে কোম্পানির মালিক গোপালগঞ্জ সদরের হাবিবুর রহমান শেখ। নিবন্ধন অনুযায়ী বাসটিতে যাত্রী আসন সংখ্যা ৪০টি। তবে পুলিশ বলছে, নিহত ১৯ আর আহত ৩০ জন ছাড়াও সেখানে অন্তত ৬৩ যাত্রী ছিলেন।

যেভাবে দুর্ঘটনা: বাসটিতে থাকা আহত কয়েক যাত্রী জানিয়েছেন, খুলনা থেকে ছেড়ে আসা বাসটি গোপালগঞ্জে যাত্রী তোলে। এর পরই বাসটি দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি মাসুদ আলম বলছিলেন, মনে হচ্ছিল চালক ঘুমিয়ে বাসটি চালাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর পরই সেটি উল্টাপাল্টা চলছিল। এরপর সেকেন্ডের মধ্যেই সড়কের অনেক নিচে তারা ছিটকে পড়েন।

হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. শামসুল আলম বলেন, অতিরিক্ত গতির কারণে বাসটি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি। এর পরই সেটি এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে খাদে ছিটকে পড়ে। এখন কেন নিয়ন্ত্রণ হারাল, যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল কি না—তা তদন্তে বের হবে।

শিবচর হাইওয়ে পুলিশের ওসি আবু নাঈম মো. মোফাজ্জেল হক বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতির কারণে বাসটির চাকা ফেলে চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি খাদে পড়ে যায়।

দুর্ঘটনায় আহত কামাল মিয়া জানান, তিনি ভাঙ্গা থেকে বাসটিতে ওঠেন। গাড়িভর্তি লোক দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হয়ে গাড়িটা পইড়া গেল।

দুর্ঘটনার সময় পাশেই ক্ষেতে কাজ করছিলেন স্থানীয় রাইসুল হাওলাদার। তিনি বলেন, ‘আমি হাইওয়ের পাশের ক্ষেতে রসুন তুলছিলাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দ শুনতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে তাকিয়ে দেখি একটা গাড়ি পইড়া গেছে। অনেক মানুষ বাবা গো মাগো কইয়া কানতাছে। কাছে গিয়ে দেখি লাশ আর লাশ, গাড়িটাও ভাইঙ্গা গেছে।’

নিহত যারা: দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস, থানা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। স্থানীয় লোকজনও তাতে অংশ নেন। উদ্ধারকারীরা ভেতর থেকে ভাঙা জানালা দিয়ে, ক্ষতিগ্রস্ত অংশ অপসারণ করে ভেতরে আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার করেন। বাসের ভেতর থেকেই কয়েকজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মাদারীপুরে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান কয়েকজন। তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ জনকে নিয়ে আসা হলে দুজন মারা যান। নিহত ১৯ জনের মধ্যে ৯ জনই গোপালগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার। বাকিরা খুলনা ও ফরিদপুরসহ আশপাশের এলাকার।

নিহতরা হলেন—গোপালগঞ্জে গোপীনাথপুর এলাকার তৈয়ব আলীর ছেলে হেদায়েত মিয়া (৪৫), বনগ্রাম এলাকার শামসুল শেখের ছেলে মোস্তাক আহমেদ (৪০), সদর উপজেলার নশর আলী শেখের ছেলে সজীব শেখ (২৬), পাচুরিয়া এলাকার মাসুদ হোসেনের মেয়ে ঢাবি ছাত্রী সুইটি আক্তার (২১), টুঙ্গিপাড়ার কাঞ্চন শেখের ছেলে কবির হোসেন শেখ (৫৫), সদর উপজেলার আবু হেনা মোস্তফার মেয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্রী আফসানা মিমি (২৪), গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ও সদর উপজেলার শান্তি রঞ্জনের ছেলে অনাদী রঞ্জন মজুমদার (৫৩), সদরের মিনহাজ বিশ্বাস (২২) ও মুকসুদপুর এলাকার আমজেদ আলীর ছেলে মাসুদ আলী (৩২)। খুলনার সোনাডাঙ্গা এলাকার শেখ মোহাম্মদ আলীর ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন (৪০), সাউথ মেন্টাল রোড এলাকার চিত্ত রঞ্জন ঘোষের ছেলে চিন্ময় প্রসূন ঘোষ, আমতলা এলাকার শাহজাহান মোল্লার ছেলে আশফাকুর জাহান লিংকন, ডুমুরিয়া এলাকার পরিমল সাদুখা ছেলে মহাদেব কুমার সাদুখা; বাগেরহাট জেলা শহরের শান্তি রঞ্জন মজুমদারের ছেলে অনাদি মজুমদার; ফরিদপুরের সৈয়দ মুরাদ আলীর ছেলে মো. ইসমাইল হোসেন; নড়াইলের লোহাগড়া এলাকার বকু শিকদারের ছেলে ফরহাদ শিকদার; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলী আকবরের ছেলে ও ইমাদ পরিবহন বাসটির চালক জাহিদ হাসান, চালকের সহকারী মিরাজ এবং কন্ডাক্টর পাবনার সুজানগরের গহর আলীর ছেলে ইউসুফ আলী।

তাদের মধ্যে মিনহাজ বিশ্বাস শেখ আলী আকবর ঢাকা মেডেকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজীবুল ইসলাম জানান, নিহত সবার পরিচয় মিলেছে। রোববারই মরদেহ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। লাশ দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে ও আহতের চিকিৎসায় ৫ হাজার টাকা করে তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে।

জাজিরা ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা শেখ আবুল হাসেম জানান, বাসের মধ্য থেকে ১৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। মরদেহ শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রাখা হয়েছে। আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তীব্র তাপদাহে বৃষ্টির জন্য নামাজ ও প্রার্থনা

বিএনপি নেতা গয়েশ্বরের জামিন

শনিবারও খোলা থাকবে স্কুল, আসছে নতুন সিদ্ধান্ত

প্রতিদিন ৫০টি চড়-থাপ্পড়েই বাড়বে নারীদের সৌন্দর্য!

মোস্তাফিজের নতুন নামকরণ চেন্নাইয়ের

চাঁপাইনবাবগঞ্জে হিটস্ট্রোকে ট্রাফিক পরিদর্শকের মৃত্যু

ঢাকার ‘নীল জোছনা’য় পাওলি দাম

অ্যানড্রয়েড ফোনে ই-সিম বদলানো যাবে সহজে

চিতাবাঘের আক্রমণ থেকে তারকা ক্রিকেটারকে বাঁচাল কুকুর

বৃষ্টি কবে থেকে, জানাল আবহাওয়া অফিস

১০

আগুনে পুড়ছে শাল-গজারির বন

১১

বিএনপি যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসতে মরিয়া: কাদের

১২

সমর্থকদের সমালোচনায় হাসি পায় সাকিবের

১৩

ঢাকার কোথায় তাপমাত্রা কম ও তীব্র

১৪

হোয়াইট বোর্ডকে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার

১৫

বৃষ্টির প্রার্থনায় অঝোরে কাঁদলেন রাঙামাটির মুসল্লিরা 

১৬

বৈদ্যুতিক খুঁটিতে প্রাইভেটকারের ধাক্কা, কৃষকলীগ নেতা নিহত

১৭

৬০ হাজার টাকা বেতনে ওয়ার্ল্ড ভিশনে চাকরি

১৮

আ.লীগ লুটপাট করে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর করেছে : রিজভী

১৯

কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা

২০
*/ ?>
X