মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণ ‘পাচ্ছেন’ জিল হোসেন

হাইকোর্ট।
হাইকোর্ট।পুরোনো ছবি

শিক্ষা সনদের দাবিতে জিল হোসেন যখন ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন, তখন তিনি ২৩ বছরের টগবগে যুবক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুলে ফেল দেখানো হয়েছিল তাকে। যে সনদের জন্য আইনি লড়াই শুরু করেছিলেন, সেই সনদ তাকে দেওয়া হয় ৪৭ বছর বয়সে। তখন চাকরিতে ঢোকার সব সুযোগ শেষ। বিপর্যস্ত জীবন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করেন সিরাজগঞ্জের চিলগাছা গ্রামের জিল। নিম্ন আদালত ২০০৮ সালে জিলকে ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দিয়ে রায় দেন। এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টে আপিল করে। হাইকোর্টে যেন বিচার আর শেষ হয় না। এরই মধ্যে দুবার স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে থাকেন জিল হোসেন। মৃত্যুর আগে বিচার দেখে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। দীর্ঘ ভোগান্তি আর এক রাশ বঞ্চনা নিয়ে গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি জিল হোসেন মারা যান।

গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আপিল খারিজ করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, নিম্ন আদালতের দেওয়া ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায় বহাল রাখা হলো। একই সঙ্গে ২০০৮ সাল থেকে ওই টাকার বিপরীতে প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশসহ পরিশোধ করতে হবে। জিল হোসেনের উত্তরাধিকারদের এই টাকা পরিশোধ করবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল খারিজ করে বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমির ও মিয়া মো. ইশতিয়াক। আর প্রয়াত জিল হোসেনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট চঞ্চল কুমার বিশ্বাস। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাসকে জিল হোসেনের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য ২০১৮ সালে

নিয়োগ দেয়। আইনজীবী জানিয়েছেন, আদালতের আদেশে সবমিলিয়ে প্রায় ৫ কোটি টাকা পাবেন জিল হোসেনের পরিবার। ৪৮ বছরের আইনি লড়াইয়ের পর এই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পথ সুগম হলো।

১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে জিল হোসেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের (কৃষি) পরীক্ষার্থী ছিলেন। পরীক্ষা হয় ১৯৭৩ সালে। ভুল করে মাত্র দশমিক ৫ মার্ক যুক্ত না করায় অকৃতকার্য হন। এই ফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করেন; কিন্তু কাজ হয়নি। প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে মামলা করেন। আদালত ওই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত এবং ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাকে অকৃতকার্য করানোকে বেআইনি ঘোষণা করেন। এখানেই জিল হোসেনের মামলার পরিসমাপ্তি টানা যেত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা না করে ওই রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে জজ আদালতে এবং পরে হাইকোর্টে আপিল করে। এরপর নানা ধাপ পেরিয়ে ১৯৭৮ সালে মুনসেফ আদালত এবং ১৯৮৩ সালে হাইকোর্ট থেকে জিল হোসেন পক্ষে রায় পান।

১৯৮৬ সালে তিনি আবেদন করলে বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পাস মার্ক দিয়ে সার্টিফিকেট দেয় ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর। একপর্যায়ে ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পর কার্যকর করে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে।

ক্ষতিপূরণ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ অক্টোবর রায় দেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে ফাস্ট আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর মামলাটির বিচারে কালক্ষেপণ শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। মামলাটি প্রায় ২০০ বার আদালতের কার্যতালিকায় আসে। বেঞ্চ পরিবর্তন হয় একাধিকবার। সর্বশেষ হাইকোর্টের উপরোক্ত বেঞ্চ শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার রায় দেন। জিল হোসেনের ছোট ছেলে কিরণ খন্দকার কালবেলাকে বলেন, ‘মামলা চালাতে গিয়ে জমি-জমা যা ছিল, প্রায় সবই বিক্রি করেন বাবা। ১৯৯৭ সালে মার্কশিট পাওয়ার পর বাবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেন। এর সঙ্গে আরও ৩৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করে ক্ষতিপূরণের মামলাটি করেন। কিন্তু হাইকোর্টে মামলা চালানোর মতো আর সামর্থ্য ছিল না। যে কারণে দারস্থ হই সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির কাছে। কমিটি ২০১৮ সালে বিনা ফিতে মামলা পরিচালনার জন্য একজন আইনজীবী দেন।’ কিরণ খন্দকার বলেন, ‘বাবা বেঁচে থাকতে মামলার বিচার দেখে যেতে পারলেন না। বিচার দেখে যেতে পারলে সে একটু শান্তি পেত। কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় সেই সুযোগ বাবা পাননি। এখন আমরা চাই আমাদের ক্ষতিপূরণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন দ্রুত বুঝিয়ে দেয়।’

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com