বিএনপি রাজপথেই খুঁজবে তত্ত্বাবধায়কের সমাধান

বিএনপি।
বিএনপি।ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের জন্য ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে বলে মনে করছে বিএনপি। প্রায় দেড় যুগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির দাবি, নতুন এই ভিসা নীতি বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিরই প্রতিধ্বনি। বিএনপি নেতাদের পর্যবেক্ষণ, এই পদক্ষেপে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর আরও চাপ বেড়েছে, যা আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তবে এটাই সবকিছু নয়। কারণ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, আর সে দাবি এখনো আদায় হয়নি। ফলে মার্কিন এই পদক্ষেপের পরও রাজপথেই সমাধান খুঁজবে দলটি। তাই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকা বিএনপি।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি দেশ, জাতি, জনগণ এবং সরকারকে একটি ভালো ইলেকশনের দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন অনেকে। যার উদাহরণ হিসেবে ভিসা নীতি ঘোষণার পরপরই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের নেতাদের এক টেবিলে বসার ঘটনাকে তুলে ধরা হচ্ছে। কারণ, নির্বাচন সামনে রেখে সংকট সমাধানে বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের কথা বলা হলেও এ ঘটনার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় বসেননি; যদিও ভেতরে ভেতরে আলোচনা চলছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে। তাই এ ঘটনা আগামী নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট সমাধানের একটি অর্থবহ ইঙ্গিত বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু কালবেলাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এটা একেবারে বাংলাদেশের জন্য একটি ভিসা নীতি। আমরা বিশ্বাস করি, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। তবে স্বাভাবিক কারণে কোন পদ্ধতিতে সে নির্বাচন হবে, যুক্তরাষ্ট্র তা বলেনি। এ ক্ষেত্রে আমরা ১৪ বছর ধরে বলে আসছি, কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছি এবং এই দাবিতে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করছে। তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বিগত দুটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি বলেই বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দাবির ৮০ শতাংশ মেনে নিয়েছে। কারণ, তারাও ভালো ইলেকশনের কথা বলছে। আমরাও সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছি। তবে আমরা মনে করি, নির্দলীয় সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।

বিএনপির এই নেতা দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতিটা আগামীতে দেশ, জাতি, জনগণ এবং সরকারকে একটা ভালো ইলেকশনের দিকে নিয়ে যাবে। সেজন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি দাবি আদায়ে বিএনপির আন্দোলনও অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত বুধবার একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না দেশটি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ওইদিন এক বিবৃতিতে এ ঘোষণা দেন।

এদিকে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পরদিন গত বৃহস্পতিবার বিএনপির নীতিনির্ধারকরা ভার্চুয়ালি জরুরি বৈঠক করেছেন। তারা সেখানে মার্কিন নতুন ভিসা নীতি, তাদের স্ট্রাটেজি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। মার্কিন এই পদক্ষেপকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর একটা বড় চাপ হিসেবে দেখছেন নীতিনির্ধারকরা। তারা মনে করছেন, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে আগামীতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আগে থেকেই সরকারের ওপর বিদেশি চাপ অব্যাহত রয়েছে। মার্কিন নতুন এই ভিসা নীতির পর সেই চাপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সরকার এখন সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে কিংবা সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হবে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বাধ্য হবে। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথের আন্দোলনও চালিয়ে যাবে দলটি।

আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসা নীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। গত বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই নীতি ক্ষমতাসীনদের ভোট কারচুপির বিরুদ্ধে বড় ধরনের ‘সিগন্যাল’। এটি আগামী দিনে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন বাংলাদেশকে অর্জন করতে হবে উল্লেখ করে খসরু বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যেদিন ভোট প্রয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে, সেদিন হবে বাংলাদেশের জনগণের সফলতা। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অনেক পদক্ষেপ এখানে নিতে হবে, যাতে তারা (আওয়ামী লীগ) আবারও ভোট চুরি করে দেশের ক্ষমতা দখল করতে না পারে।

দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ গতকাল কালবেলাকে বলেন, বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে। আমাদের এই যে দাবি এটা নিয়ে বিদেশিরা কেন বলবে? নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আসবে কি আসবে না, এটা তো আমাদের দেশের একটা সাংবিধানিক ব্যাপার, আইনগত একটা ব্যাপার। ডিপ্লোমেসির কারণে বা কৌশলগত কারণে এ ব্যাপারে বিদেশিরা কোনো মতামত দিতে পারে না, দেয় না। কিন্তু তারা বাংলাদেশে একটা অত্যন্ত স্বচ্ছ নির্বাচন চায়, একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক সেটাও চায়। সেজন্য নির্বাচনের বেশ কয়েক মাস বাকি থাকলেও এখনই এই নিষেধাজ্ঞা সতর্কতা দিয়েছে, যাতে বিরোধী দলগুলো নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করতে পারে, মত প্রকাশ করতে পারে। একই সঙ্গে গায়েবি, মিথ্যা মামলা দায়ের করা থেকে যাতে সরকার বা সরকারি দল বিরত থাকে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের মনে রাখা দরকার, একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, তাদের সবাইকে এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা সতর্কতার আওতায় আনা হয়েছে। সুতরাং একটি দেশ প্রচ্ছন্নভাবে এর চেয়ে বেশি আর কী করতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় ও ভোটাধিকার প্রয়োগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে দাবি করেন এই বিএনপি নেত্রী।

আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে না বলেই যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা সতর্কতা সরকারের সাজানো-পাতানো একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগের বিরুদ্ধে বিরাট চপেটাঘাত। এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা সতর্কতার প্রতিটি লাইন আওয়ামী সরকার ও তাদের অনুগতদের বিরুদ্ধে। কারণ তারাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ নির্বাচনের জন্য একমাত্র প্রতিবন্ধক।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার তথা শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে অনড়। দলটি কোনোমতেই সংবিধানের বাইরে যাবে না। অন্যদিকে বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে। দাবি আদায় করেই তারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যেতে চায়। সংকট সমাধানে সংলাপের সম্ভাবনাও নাকচ করেছে ক্ষমতাসীনরা। তাই নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে বড় দুই দলের এমন বিপরীতমুখী অবস্থানে আগামী নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। এমন প্রেক্ষাপটে ভিসা নীতি ঘোষণার পর গত বৃহস্পতিবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। মার্কিন ভিসা নীতি যে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে, সেটা এই তিন দলকে অবহিত করেন রাষ্ট্রদূত। একই সঙ্গে কোন প্রক্রিয়ায় সে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে সৃষ্ট সংকট নিরসনের উপায় কী হতে পারে, দলগুলোকে সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে বলেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ডায়ালগের মাধ্যমে যে সংকট সমাধানের পক্ষে, সেটাও জানান পিটার হাস।

এদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন উদ্যোগে সংকট সমাধানে স্বল্প হলেও আশার আলো দেখছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অনেকে।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com