সবাইকে পেটান এডিসি হারুন

হারুন অর রশিদ।
হারুন অর রশিদ।ছবি: সংগৃহীত

আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, দায়িত্বরত সাংবাদিক থেকে শুরু করে নিজের সহকর্মী, কারও যেন নিস্তার নেই। কিলঘুসি আর লাঠিপেটার অভিযোগ যেন নিত্যসঙ্গী। বিভিন্ন সময়ে তিনি দায়িত্ব পালনে গেলেই এমন ঘটনার কথা শোনা যায়। পুলিশের এমনই এক কর্মকর্তা হলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ। নির্বিচারে মানুষ পিটিয়ে যিনি বিভিন্ন সময়ে হয়েছেন সংবাদের শিরোনাম। আর এসব কর্মকাণ্ডের দায় ঘাড়ে নিয়ে বারবার দুঃখ প্রকাশ করে যাচ্ছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিনা কারণে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের পিটিয়ে আবারও আলোচনায় এডিসি হারুন। গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে নজিরবিহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নির্বাচনে সংবাদ সংগ্রহে গেলে সাংবাদিকদের বেধড়ক পেটান পুলিশ সদস্যরা। সাংবাদিকদের অভিযোগ, এই পেটানোর নেপথ্যে ছিলেন রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ। এ ঘটনার পর দুঃখ প্রকাশ করতে হয়েছে ডিএমপির কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক থেকে শুরু করে ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদকে।

সুপ্রিম কোর্টের ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা অভিযোগ করেন, সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া সাংবাদিকসহ আইনজীবীদের ওপর রাইফেল দিয়ে মারধর করে পুলিশ সদস্যরা। কয়েকজন সাংবাদিকের মোবাইল ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়। সাংবাদিকদের কিল-ঘুসি মেরে জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া এক সাংবাদিকের বুম (মাইক্রোফোন) কেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় নিজের অসুস্থতার কথা বলে পুলিশের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করলেও এটিএন নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার জাভেদ আকতারকে বেধড়ক পেটানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা জানান, এসবের নেপথ্যে ছিলেন এডিসি হারুন অর রশিদ। তিনি সাংবাদিকদের অকথ্য ভাষায় গালাগালও করেন। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিওতেও এমন দৃশ্য দেখা গেছে। ভিডিওতে সাংবাদিকদের ওপর হারুনকে চড়াও হতেও দেখা যায়।

এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিক পেটানোর ঘটনায় তারা দুঃখিত। সাংবাদিকদের ওপর এমন ঘটনা পুরোপুরি অনিচ্ছাকৃত। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য পুলিশ সচেষ্ট থাকবে। তার বক্তব্যের পর টেলিফোনে ডিএমপি কমিশনার ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি আশুতোষ সরকারের সঙ্গে কথা বলেন। টেলিফোনে সভাপতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সে বিষয়টি দেখা হবে বলে জানান।

এ বিষয়ে ডিএমপির রমনা জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ বলেন, সুপ্রিম কোর্টের ঘটনায় আমাকেই কেন টার্গেট করা হচ্ছে? ওই সময় রমনার ডিসি স্যার উপস্থিত ছিলেন। তাহলে আমি কে? এখানে কমান্ড তো একটাই হবে। তাহলে আমাকেই কেন দোষারোপ করা হচ্ছে? হোয়াই মি?

তবে এর আগেও এডিসি হারুনের এমন আচরণে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল পুলিশ প্রশাসনকে। নিজের এক সহকর্মীকে থাপ্পড় মারার ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিওতে দেখা যায়, এডিসি হারুন এক পুলিশ কনস্টেবলকে থাপ্পড় মারছেন। গত বছরের ১৮ এপ্রিল নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী এবং সাংবাদিকদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের লক্ষ্য করে পুলিশ সদস্যদের রাবার বুলেট ছোড়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন এডিসি হারুন অর রশিদ। এ সময় ‘গুলি শেষ হয়ে গেছে’ বলায় ওই পুলিশ কনস্টেবলকে থাপ্পড় মারেন তিনি। এ ঘটনায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি হয় এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যেও এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এ ঘটনায় তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বলেছিলেন, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ডিসি রিপোর্ট করলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এরপর গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করলে বিক্ষোভে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এ ঘটনায় আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, এডিসি হারুনের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা আন্দোলনকারীদের সরে যেতে বলে লাঠিপেটা শুরু করে। এ সময় পুলিশের লাঠিপেটায় এক নারী আন্দোলনকারী সড়ক বিভাজনে পড়ে যান। তৎকালীন সময়ে ওই ঘটনার এক ভিডিওতে দেখা যায়, আন্দোলনকারীদের আটক করে নিয়ে যাওয়ার ছবি তুলতে গেলে এডিসি হারুন সাংবাদিকদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছেন। তিনি বারবার সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে যান। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাকে সরিয়ে দেন। এ সময় পোশাক পরিহিত আরও কয়েকজন সদস্যকে সাংবাদিকদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন ও ছবি তুলতে বাধা দেন। এসব ঘটনা ছাড়াও যে কোনো আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এডিসি হারুনের বিপক্ষে বেপরোয়া আচরণের অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মী, পেশাজীবী এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্টের ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ নিন্দা জানিয়েছেন সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি আহমেদ সারোয়ার ভূঁইয়া বলেন, ডিবি প্রধান হারুন ভাই ভদ্রতার খাতিরে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। এ ভদ্রতা যদি সেদিন দেখানো হতো, তবে এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। সাংবাদিক মারধর করে পুলিশের কতটুকু সুনাম হয়েছে আমি জানি না। এ ঘটনার পর পুলিশের কতটুকু অর্জন, তাও জানি না।

তিনি বলেন, এডিসি হারুন সাহেব এখানে উপস্থিত আছেন। আমি জানি না তিনি আগে সাংবাদিক ছিলেন কি না। উনি যে কয়টা প্রোগ্রামে থাকেন সে কয়টা প্রোগ্রামে সাংবাদিকের মাইর খাওয়াটা বান্ধা। আমাদের চিফ জাস্টিসও গর্ব করে বলেন, তিনি এক সময় সাংবাদিক ছিলেন; কিন্তু এডিসি হারুন সাহেব বোধহয় সাংবাদিকদের নিয়ে এসব ভাবেন না। এখন এডিসি হারুন সাহেব আমাদের ডিবি প্রধান হারুন সাহেবের সম্মান কতটুকু বাড়াচ্ছেন তিনিই জানেন। আমাদের আর কিছু বলার নেই। আমরা চাইলে পারতাম বিভিন্ন কর্মসূচি দিতে, রাজনৈতিক রং দিতে; কিন্তু আমরা সুপ্রিম কোর্টের অভিভাবক প্রধান বিচারপতির কাছে আমাদের কথা বলেছি। তিনি এবং আরও ৮ বিচারপতি আমাদের কথাগুলো শুনেছেন। আইনমন্ত্রী ফোন দিয়ে বলেছেন, এই বিষয়টি দেখব। এ ঘটনা বাড়ুক আমরা আর চাই না। আমরা চাই এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে।

এসব বিষয়ে এডিসি হারুন অর রশিদ বলেন, বিভিন্ন সময় আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, যে সাংবাদিকদের গায়ে হাত তুলেছি, এসব অভিযোগের কোনো ফুটেজ কি কারও কাছে আছে? শুধু শুধুই সবসময় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়। এটি আমারও প্রশ্ন যে, আমি কার কাছে অভিযোগ দেব। আমার তো অভিযোগ দেওয়ার জায়গা নেই।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com