
দুর্বল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও সরকারের অর্জিত আয় ব্যবহারে নয়ছয় ও অপচয় বন্ধ না হওয়ায় প্রতিবছর বড় বাজেট ঘাটতি দেখা যায়। সরকারের প্রতিশ্রুতি পূরণের বেশি চেষ্টা এবং সেইসঙ্গে পরিচালন কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে গিয়ে বাজেটের আকার বা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রতিবছর বড় হচ্ছে। এতে আয় ও ব্যয়ের হিসাবে ঘাটতির পরিমাণও বড় হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের কম আয় থেকে পাওয়া নগদ অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে গিয়ে বলির পাঁঠা হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন পরিকল্পনা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটেও এর ধারাবাহিকতা দেখা যাবে। বাজেটে ঘাটতির সম্ভাব্য আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর এডিপি বাস্তবায়ন পরিকল্পনার চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। যেখানে এই অর্থের প্রায় সবটাই জোগান দিতে হবে ধার-কর্জ বা ঋণের মাধ্যমে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের মাধ্যমে জোগান দেওয়া হবে ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৯৪ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করতে হবে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে।
এভাবে প্রতিবছরই এডিপি অংশ বাস্তবায়নে ধার করা টাকার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। সেই অর্থও ছাড় হয় কিস্তিতে। বিনিময়ে দিতে হয় মোটা অঙ্কের সুদ। এতে এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলোর ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাস্তবায়নেও লাগছে দীর্ঘ সময়। আবার টাকার সংস্থান করতে গিয়ে অনেক প্রকল্পের কাজ মাঝপথে লম্বা সময় বন্ধও থাকছে। সব মিলে প্রকল্প বাস্তবায়নে গুণগত মান নিয়েও সংশয় তৈরি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তা জনভোগান্তির কারণও হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে জানান, ধার-কর্জনির্ভর এডিপি বাস্তবায়ন ছাড়া উপায়ও নেই সরকারের হাতে। ব্যয় বেশি হলে আয় কম হলে তখন সরকারকে অগ্রাধিকার নির্ধারণ ছাড়া বিকল্প থাকে না।
তিনি জানান, এর থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো সরকারের আয় বাড়ানো। এটা বাড়াতে হলে সরকারের রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) যে পরামর্শগুলো রয়েছে, তা বাধ্যতামূলক বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে সরকার অভ্যন্তরীণ আয়েই স্বনির্ভর হতে পারবে। এতে বাজেটের ঘাটতি কমবে। ঘাটতি কম হলে ধার-কর্জ কম হবে। সুদ পরিশোধে প্রতিবছর গড়ে লাখ কোটি টাকা বেচে যাবে। একইভাবে বাড়তি আয় দিয়ে এডিপিও বাস্তবায়ন করতে পারবে। সেক্ষেত্রে যদি কিছু ঋণ নেওয়ারও প্রয়োজন হয়, তা বিদেশ থেকে নেবে, কারণ, দেশীয় ঋণ বিদেশির তুলনায় ব্যয়বহুল।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, সরকারের দুই ধরনের ব্যয় রয়েছে। একটি সরকারের আবর্তক ব্যয় বা পরিচালনা খরচ, অন্যটি হলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পরিকল্পনা (এডিপি) বাস্তবায়ন ব্যয়। এর মধ্যে সরকারের আবর্তক ব্যয় বা পরিচালনা খরচ বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োজনের তাগিদ অনুভব করা মাত্র, তা রাজকোষ থেকে সরকারকে মেটাতেই হয়। ফলে কোন ব্যয়টি সরকার আগে করবে—তার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হয়। আর এখানেই পিছিয়ে পড়ে এডিপির অর্থ বরাদ্দ। ফলে সরকারের কর্মকাণ্ড যে দীর্ঘসূত্রতা, অর্থছাড়ের জটিলতা কিংবা ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধি এবং গুণগত মান নিয়ে যে প্রশ্ন ওঠে—তার নেপথ্য অন্যতম কারণ হলো সাধারণত ঘাটতির অংশ থেকেই এডিপির ব্যয় মেটানো হয়। ওই ঘাটতি পূরণে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড়ে সরকারকে বিদেশি দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা সাপেক্ষে চুক্তি করতে হয় এবং এরপর অর্থ ছাড় পাওয়ার জন্য অপক্ষো করতে হয়। একইভাবে দেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকারকে অভ্যন্তরীণ বেসরকারি খাতের অবস্থা এবং ব্যাংক ব্যবস্থার সক্ষমতা চিন্তা করতে হয়।
জানা গেছে, আগামী ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা সরকারি ব্যয়ের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (চূড়ান্ত হিসাব পরিবর্তনও হতে পারে)। সেখানে সরকারের আবর্তক ব্যয় নির্ধারণ করা হতে পারে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এই আবর্তক ব্যয়ের চারটি অগ্রাধিকার খাতের মধ্যে অন্যতম হলো ঋণের সুদ পরিশোধ। ফলে বিগত সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে দেশি-বিদেশি উৎস্য থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধেই এর থেকে খরচ করতে হবে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। দেশের অর্থ ব্যবহারের সংবিধান অনুযায়ী ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে কোনো টালবাহানার সুযোগ নেই। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতার পেছনে খরচ করতে হবে ৭৭ হাজার কোটি এবং পণ্য ও সেবা ক্রয়ে খরচ করতে হবে ৪০ হাজার কোটি। সরকারের কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে হলে এসব খরচ না করে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এর বাইরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতেও সরকারকে খরচ করতে হবে আরও ২ লাখ ৫ হাজার কোটি এবং অন্যান্য খাতে বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে ৭২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা, যা সরকারকে প্রয়োজন হওয়া মাত্রই করতে হবে।