রাজকুমার নন্দী
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৩, ০৯:০৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিএনপি খুঁজছে ভোট ঠেকানোর কৌশল

বিএনপি খুঁজছে ভোট ঠেকানোর কৌশল

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া বিএনপি। দলটির দাবি, চলমান আন্দোলনে বেশিরভাগ বিরোধী দলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও সম্পৃক্ত হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সমর্থন দিচ্ছে। ফলে আন্দোলন ক্রমেই বেগবান হচ্ছে। দাবি না মানলে আগামীতে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির হাইকমান্ডের। শেষ পর্যন্ত যদি আন্দোলনে সফলতা না আসে এবং বিএনপিকে যদি আবারও জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কটের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, সেক্ষেত্রে সেই নির্বাচন ঠেকাতে কী ধরনের কৌশল নেওয়া যেতে পারে, দলটির ভাবনায় আন্দোলনের পাশাপাশি সে বিষয়টিও রয়েছে। ২০১৪-এর নির্বাচন ও নির্বাচনপূর্ব আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় এমন ভাবনা দলটির। অবশ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের ওপর বিদেশিদের অব্যাহত চাপ এবং শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যেতে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরাসহ আরও কয়েকটি দলের ঘোষণায় বিএনপি মনে করছে, এবার আর একতরফা নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না। বিরোধী দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলনে ক্ষমতাসীনরা পদত্যাগে বাধ্য হবে। সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত বিএনপি এবার রাজপথ ছাড়বে না বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, মানুষ এ সরকারের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে। জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা এই সরকারকে বিদায় করবেই। তারা ভোট চুরি, প্রহসনের নির্বাচন হতে দেবে না। বাংলাদেশের মানুষ যখনই অবস্থান ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রতিবারই তারা জয়ী হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে চলমান যুগপৎ আন্দোলনে বেশিরভাগ দলই সম্পৃক্ত হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও এই আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে। বিদেশিরাও সরকারকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে। সুতরাং এবার আর কোনো প্রহসনের নির্বাচন করার সুযোগ নেই। সরকারকে জনগণের দাবি মানতেই হবে। ২০১৪ সালের মতো কোনো নির্বাচন আর হবে না বলে দাবি করেন বিএনপির এই নেতা।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিএনপির লক্ষ্য, বেশিসংখ্যক দলকে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা। পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে ক্ষমতাসীনদের ওপর বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার চাপ অব্যাহত রাখা। তা সত্ত্বেও যদি দলীয় সরকারের অধীনে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ও; তা যেন অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই বর্জন করে, সেটাও নিশ্চিত করা।

জানা যায়, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ৩৮টি দলের মধ্যে বিএনপিসহ ছয়টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। সব দল এরই মধ্যে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যেতে বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছে। তবে আন্দোলন সত্ত্বেও যদি নির্বাচন হয়, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই যাতে সেই নির্বাচন বয়কট করে, সেজন্য ভেতরে ভেতরে কাজও করছে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকলেও যেসব দল শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে কিংবা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। সম্প্রতি বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের (পীর সাহেব চরমোনাই) সঙ্গে সেখানকার মাহফিলের মেহমানখানায় বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল বৈঠকও করেছে। এ ছাড়া সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জি এম কাদেরের অংশ) সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে দলটি। অবশ্য কিছু দল শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। দলগুলো যেন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে, সেজন্য তাদের সঙ্গেও ভেতরে ভেতরে যোগাযোগ করছে বিএনপি। রমজানে ‘ইফতার রাজনীতির’ মধ্য দিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা ছাড়াও আন্দোলনের বাইরে থাকা ওইসব বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বিশেষ মনোযোগী হবে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। দলটির লক্ষ্য, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করা।

বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জন করে, সেক্ষেত্রে ১৪ দলীয় জোট ছাড়াও নিবন্ধিত বেশ কয়েকটি দল রয়েছে, যারা শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত। তাদের মধ্যে অন্যতম গণতন্ত্র বিকাশ মঞ্চের প্রধান শরিক ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি। দলটির চেয়ারম্যান শেখ ছালাউদ্দিন ছালু কালবেলাকে বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ইভিএম বা ব্যালট যে পদ্ধতিতে হোক, গণতন্ত্র অব্যাহত রাখার স্বার্থে এনপিপি তাতে অংশ নেবে। ন্যূনতম ২৫০ আসনে প্রার্থী দেওয়া হবে। বিগত সংসদ নির্বাচনে এনপিপি ৮২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল বলে জানান দলটির এই চেয়ারম্যান।

দশম সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হলেও দলীয় সরকারের অধীনে ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে বিএনপি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দলীয় অবস্থান পরিবর্তন করে গণফোরাম সভাপতি ভিন্ন মতাদর্শের ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। যদিও নির্বাচনের আগে ড. কামালের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপ করে বিএনপি। তবে দলটির দাবি, ওই সংলাপে দেওয়া কোনো ওয়াদাই পূরণ করেনি সরকার।

দেখা যায়, ওই নির্বাচনের প্রচারণায় বিএনপির বেশিরভাগ নেতাই অংশ নিতে পারেননি। স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবসহ অনেক নেতা সরকারি দলের আক্রমণের শিকার হন। স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ এবং নেত্রকোনা জেলা বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. আনোয়ারুল হকসহ অনেককে বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহরে এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নির্বাচনী প্রচারণায় হামলা চালানো হয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, ভোটের আগে নির্বাচনী মাঠই ছাড়া হয়ে যায় বিএনপি। দলটির দাবি, ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করা হয়। প্রশাসনের সহায়তায় দিনের ভোট আগের দিন রাতে ডাকাতি করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, নির্বাচনে দলটি মাত্র ছয়টি আসন পায়। আর জোটগতভাবে পায় আটটি।

বিএনপি ফের শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে ১০ দফার ভিত্তিতে গত ২৩ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন করছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী এ আন্দোলনকে সফল করতে চায় বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে রোজার পরপরই রাজপথে শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। বিএনপি অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে সংগঠন গুছিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সেই আন্দোলনে নামতে চায়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত ১০ সাংগঠনিক বিভাগের দলসমর্থিত সাবেক ও বর্তমান ২ হাজার ৩৬৭ জন ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির হাইকমান্ড। যারা পদবঞ্চিত, মান-অভিমান, ক্ষোভে দীর্ঘদিন দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। তাদের মধ্যে ৩২০ জন চেয়ারম্যান বক্তব্যে বিএনপিকে চলমান আন্দোলন, দল পুনর্গঠন এবং নির্বাচন বিষয়ে ২৯ দফা প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবনায় বিএনপিকে সরকারের কোনো ফাঁদে পা না দিয়ে রাজপথেই দাবি আদায়ের তাগিদ দেন তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা। তারা এবার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এ ছাড়া বিএনপির হাইকমান্ডকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া; আন্দোলনের রোডম্যাপ প্রস্তুত করা; অভিজ্ঞদের হাতে দায়িত্ব দেওয়া; সিদ্ধান্ত গ্রহণে জামায়াতে ইসলামী এবং যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে প্রভাব বিস্তার করতে না দেওয়ার পরামর্শও দেন এসব জনপ্রতিনিধি। তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের এসব প্রস্তাবনা এখন পর্যালোচনা করছে বিএনপি।

এদিকে, বড় আন্দোলনে নামার আগে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিরও মতামত নিতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড। আগামী ১৫ এপ্রিল ৫০২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সবার সঙ্গে মতবিনিময় ও ইফতারের পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ২০১৬ সালের মার্চে বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর খিলক্ষেতের হোটেল লা মেরিডিয়েনে দলটির নির্বাহী কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষণাকে সামনে রেখে দলের নির্বাহী কমিটির ওই বৈঠক ডাকা হয়েছিল।

বিএনপির চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান বলেন, ১০ দফা দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলন চলছে। প্রতিটি কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছে। আন্দোলন ক্রমেই বেগবান হবে। দাবি না মানলে আন্দোলনেই সরকারের পতন ঘটবে, এটা পরিষ্কার। নেতাকর্মীরা মাঠে আছে, মাঠে থাকবে। আন্দোলনে গুলি করা হচ্ছে, তারপরও নেতাকর্মীরা দমেনি। সরকারের পতন ছাড়া তারা কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবে না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জাতীয় দিবসে হাসপাতালে আলোকসজ্জা না করায় শোকজ

১৫ হাজার টিকিটের জন্য ঘণ্টায় ২ কোটিবার চেষ্টা

চাচার ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ভাতিজা নিহত

১৫৯ জনবল নিয়োগ দেবে রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়

হোয়াইটওয়াশ বাঁচানোর মিশন টাইগারদের

অলীক স্বপ্ন 

সৌদিতে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশি যুবকের মৃত্যু

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর পাবিপ্রবিতে পানির ফিল্টার স্থাপন

সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে লিটন : কোচ

জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ

১০

ডামি নির্বাচনের সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে : রিজভী

১১

কাশ্মীরে যাত্রীবাহী গাড়ি গভীর খাদে, নিহত ১০

১২

যুক্তরাষ্ট্রের জার্সিতে খেলবেন সাবেক কিউই তারকা

১৩

রাজার আমন্ত্রণে ভুটানে তথ্য প্রতিমন্ত্রী

১৪

নেতাকে ফাঁসাতে গিয়ে আ.লীগ কর্মী গ্রেপ্তার

১৫

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ / স্বাধীনতা দিবসের নামে চাঁদা দাবি করায় ইউএনওর ২ স্টাফ বদলি

১৬

স্কুটারে বসেই অফিস করছেন তিনি, ভিডিও ভাইরাল

১৭

মোস্তাফিজদের ম্যাচ দেখায় নতুন রেকর্ড

১৮

এখনো যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে ফিলিস্তিনিরা

১৯

‘বিএনপি নেতাদের কথা শুনলে জিয়াউর রহমানও লজ্জা পেয়ে যেতেন’

২০
*/ ?>
X