শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৩, ০৮:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রাথমিকে ৮০ ভাগ শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণের বাইরে

প্রাথমিকে ৮০ ভাগ শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণের বাইরে

দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটাতে এসেছে নতুন শিক্ষাক্রম। কিন্তু শুরু থেকেই এই শিক্ষাক্রম নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। সেসব সমালোচনার কেন্দ্রে ছিল শিক্ষক প্রশিক্ষণ, এখনো সমালোচনা চলছে। এরই মধ্যে মাধ্যমিকের (৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি) শিক্ষকদের অভিযোগ, তারা ত্রুটিপূর্ণ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। সে কারণে শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে বেগ পেতে হচ্ছে।

এদিকে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে অ্যাপ না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ঠিকমতো হচ্ছে না। অন্যদিকে, প্রধান শিক্ষকরা এখনো রয়ে গেছেন প্রশিক্ষণের বাইরে। এ ছাড়া প্রাথমিকের (প্রথম শ্রেণি) ৮০ শতাংশ শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণ পাননি। এসব কারণে দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এলোমেলোভাবে চলছে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদান।

দেশের সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত সমান না হওয়া, শিক্ষাক্রম উপযোগী প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও শিক্ষা উপকরণে ঘাটতি থাকা, মাধ্যমিকে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না হওয়া, প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে না পারা, প্রাথমিকে প্রশিক্ষণ শেষ করতে না পারা, শিক্ষকদের মূল্যায়ন অ্যাপ সরবরাহ না করা, সিলেবাস নির্ধারণ না করে দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান পুরোদমে শুরু করা যায়নি।

জানা গেছে, জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদানকে সামনে রেখে প্রথমবারের মতো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় অনলাইনে, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। সাড়ে তিন লাখ শিক্ষক এই প্রশিক্ষণের আওতায় এসেছেন—মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এমন দাবি করলেও সার্ভার জটিলতায় বেশিরভাগ শিক্ষক তখন অনলাইনে যোগ দিতে পারেননি। পরে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে ৫ দিনের সরাসরি প্রশিক্ষণ। বাদ পড়া শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পান জানুয়ারির শেষ দিকে। এরপর শিক্ষকদের আর কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। ওই প্রশিক্ষণের ওপর ভিত্তি করেই তারা নতুন কারিকুলামের পাঠদান করছেন। নামমাত্র প্রশিক্ষণের কারণে নানামুখী সমস্যায় পড়ছেন শিক্ষকরা।

এদিকে মাউশির প্রশিক্ষণে স্বল্পতা থাকায় যেসব স্কুলে ট্রেইনার ও মাস্টার ট্রেইনার শিক্ষক রয়েছেন তারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেসব স্কুলে ‘ইনহাউস প্রশিক্ষণ’ দিচ্ছেন। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে সেটিও করা সম্ভব হচ্ছে না।

মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘বছরজুড়েই চলবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। তবে চাহিদার তুলনায় মাউশির জনবল কম। প্রশিক্ষণের বিষয়টি দেখার জন্য শিক্ষাক্রম ডিসেমিনেশন স্কিমে নতুন পরিচালক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনবল না দেওয়ায় তিনি একা কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করতে পারছেন না। তিনি বলেন, আমাদের স্কিমের যেটুকু কাজ ছিল সেটি শেষ হয়েছে। বাকি আছে শুধু প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। এটি স্কিমেই আছে। সে অনুযায়ীও হতে পারে। আবার নতুন ডিরেক্টর চাইলে নতুন স্কিমও করতে পারেন।

এ বিষয়ে শিক্ষাক্রম ডিসেমিনেশন স্কিমের নতুন পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজ আলী বলেন, কাজ করতে জনবল লাগে, ইকুইপমেন্ট লাগে, কম্পিউন্টার লাগে, প্রিন্টার লাগে; এগুলো হচ্ছে না। জনবল পেলে কাজ শুরু করতে পারব।

প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহ করছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল মার্চের প্রথম সপ্তাহ। যদিও এখন পর্যন্ত অনুমোদন পাইনি, জনবলও পাইনি। তবে আশা করছি দ্রুত জনবল পেয়ে যাব এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করতে পারব। তিনি আরও বলেন, শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ক্লাস করাতে গিয়ে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, তার তথ্য এনসিটিবির কাছে চলে গেছে। এনসিটিবি তাদের জন্য রিফ্রেশমেন্ট ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করবে।

জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি বাইরে হাতে-কলমে শেখার অনেক কাজ রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব কাজ সম্পাদনের জন্য বেশিরভাগ স্কুলে পর্যাপ্ত উপকরণ নেই। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার নামিদামি স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাবরেটরি থাকলেও প্রত্যন্ত স্কুলে নেই। আবার, পাঠ্যবইয়ে থাকলেও শহরের স্কুলে গ্রামীণ চাষাবাদ শেখার সুযোগ নেই। নেই খেলাধুলার মাঠও।

এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য এনসিটিবি থেকে মূল্যায়ন অ্যাপ সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু পাঠদান শুরুর দুই মাস পেরোলেও সব স্কুলে তা পৌঁছায়নি। এর ফলে মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অভিভাবকরাও উদ্বিগ্ন। তাদের চাওয়া, মূল্যায়ন পদ্ধতি যেন সহজ করা হয়। সিলেবাসও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। ফলে স্কুলগুলো যার যার মতো করে সিলেবাস বানিয়ে পাঠদান করছে।

ফেনীর দাগনভূঁঞা একাডেমির একজন শিক্ষক কালবেলাকে বলেন, অনলাইনের পর সরাসরি প্রশিক্ষণেও প্রশ্ন করার সুযোগ কম ছিল। বেশি শিক্ষককে একসঙ্গে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে গিয়ে দেখা গেছে, কেউ ভালোমতোই বুঝছে, তো অন্য কেউ সেটা বুঝতে সময় লাগছে। তাদের জন্য আলাদা করে সময় দেওয়া হয়নি। সে জন্য ইনহাউস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও সেটি ফলপ্রসূ নয়।

অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক শিক্ষকই শ্রেণিকক্ষে কিছু না বুঝিয়ে আগের নিয়মে শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে হোমওয়ার্ক করে আনতে বলছেন। এতে শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বিপাকে পড়ছেন তাদের অভিভাবকরাও। কারণ, বেশিরভাগ অভিভাবকেরও নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়বস্তু নিয়ে পর্যাপ্ত ধারণা নেই।

রাজধানীর ব্রাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শামসুন নাহার কালবেলাকে বলেন, শিক্ষকদের কাছে নতুন শিক্ষাক্রম যেমন সম্পূর্ণ নতুন, অভিভাবকদের কাছে আরও নতুন। তারা প্রশিক্ষণ নিয়েও বাচ্চাদের যথাযথ পদ্ধতিতে পাঠদান করছে না। আগের রীতিতেই ক্লাসে না বুঝিয়ে হোমওয়ার্ক দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন চার-পাঁচটি করে। নতুন পদ্ধতি হওয়ায় বাচ্চাদের পড়াশোনায় বা হোমওয়ার্কে সাহায্য করতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে অভিভাবকদেরও।

উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহুরা বেগম কালবেলাকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম খুবই আধুনিক। তবে বইয়ের কনটেন্টকে সর্বস্তরের জন্য উপযোগী করতে হবে। যেমন—বিজ্ঞানের একটি অংশ পড়াতে গেলে শিক্ষার্থীদের মাঠে নিয়ে যেতে হবে। গ্রামের স্কুল মাঠ পাবে, শহরের প্রতিষ্ঠান কোথায় যাবে? পরে ভাষাগত পরিবর্তন আনলে, উপস্থাপনটা ভিন্নভাবে করলে সেটি সর্বস্তরের জন্য উপকার হবে। এজন্য এনসিটিবিকে মতামতগুলো হজম করতে হবে। তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। তিনি বলেন, আমাদের কাছে এখনো কোনো অ্যাপ আসেনি। নিজস্ব সিলেবাস করে দেবে বলেছিল, কিন্তু সেটিও করা হয়নি সেজন্য আমরা নিজেদের মতো করে সিলেবাস করে পড়াচ্ছি।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ৬২টি পাইলটিং স্কুলের ফল প্রস্তুত করতে আমরা প্রথম অ্যাপ ব্যবহার করি। তবে এক্ষেত্রে অ্যাপে ত্রুটি ধরা পড়ে। সেজন্য আমরা অ্যাপটাকে নতুন করে কীভাবে সচল করা যায় সেটি নিয়ে কাজ করছি। সেটি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তবে, শিক্ষকরা যাতে অ্যাপ ছাড়াই মূল্যায়ন করতে পারে সেজন্য ম্যানুয়াল মূল্যায়ন পদ্ধতি চালুর চেষ্টা করছি। মার্চের শেষদিকে সেটি স্কুলগুলোতে গাইডলাইনসহ পাঠিয়ে দিতে পারব।

প্রাথমিকে প্রশিক্ষণের বাইরে ৮০ শতাংশ শিক্ষক:

দেরিতে হলেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ৬ লাখ শিক্ষককে এই প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। তবে এখন পর্যন্ত মোট শিক্ষকের ২০ শতাংশকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে পেরেছে অধিদপ্তর। মঙ্গলবার পর্যন্ত ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩০ জন শিক্ষকের মধ্যে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৬৩ জন, যা মোট সংখ্যার ২০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া শিক্ষকদের মধ্যে ৭৯ হাজার ৭০৫ জন প্রশিক্ষণ শেষে সনদ পেয়েছেন, যা অংশগ্রহণকৃতদের ৬৪.১০ শতাংশ।

এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) উত্তর কুমার দাশ বলেন, প্রশিক্ষণে আমাদের সমস্যা নেই। সব প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। আমাদের অনলাইন প্রক্রিয়াও চলছে। সরাসরি ও অনলাইন দুটো মিলিয়ে ২৫ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কেউ প্রশিক্ষণের বাইরে থাকবে না। তিনি বলেন, এবার নতুন শিক্ষাক্রমের প্রথম শ্রেণির বই গিয়েছে। ২০২৪ সালে যাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি এবং ২০২৫ সালে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি। যে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দরকার, তার মধ্যে এওপি (বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা) অনুযায়ী ১ লাখ ৩১ হাজার গণিতের শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। একই সংখ্যক বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষকের প্রশিক্ষণ চলছে। তার মানে ২০২৪ ও ২০২৫ সালের জন্য যে মাস্টার ট্রেইনার ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ দরকার, তা ২০২৩ সালের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিলেটে ট্রাক-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

ব্যারিস্টার খোকনের দলীয় পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি 

বাড়ি ফেরা হলো না বাবা-ছেলের

বাংলাদেশের দাবদাহ নিয়ে যা বলছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম

অনুষ্ঠিত হলো বিইউএইচএস -এর প্রথম সমাবর্তন

ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে : ম্যাখোঁ

ছেলেদের দোষে ডুবছেন মাহাথির মোহাম্মদ

হিজাব আইন না মানায় ইরানে ব্যাপক ধরপাকড়

তীব্র তাপপ্রবাহে বৃষ্টি চেয়ে হাজারো মুসল্লির কান্না

মানব পাচারের দায়ে একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

১০

ঝিনাইদহে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর যাবজ্জীবন

১১

কারিগরির ফাঁকা সনদ মিলল তোষকের নিচে, গ্রেপ্তার কম্পিউটার অপারেটর

১২

ঝিনাইদহে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায়

১৩

ভোট দিলে যে শহরে মিলবে ফ্রি বিয়ার, ট্যাক্সিসহ নানা সুবিধা

১৪

কুমিল্লায় পানিতে ডুবে ৪ শিশুর মৃত্যু

১৫

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফখরুলের সাক্ষাৎ

১৬

চট্টগ্রামে জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার বাঘা শরীফ

১৭

সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরলেন শিক্ষামন্ত্রী 

১৮

৭৩ বছরে ছাত্র ইউনিয়ন  

১৯

কৃষক খুনের ঘটনায় থামছে না ভাঙচুর ও লুটপাট

২০
*/ ?>
X