
ভারত থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করতে ‘ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন’ চালুকে দুই দেশের জন্য একটি মাইলফলক অর্জন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মৈত্রী পাইপলাইন আমাদের দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে সহযোগিতা উন্নয়নের একটি মাইলফলক অর্জন। এটি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে। এই পাইপলাইনের মতো আগামী দিনেও আরও সফলতা বাংলাদেশ-ভারত উদযাপন করবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আমরা একই সঙ্গে কাজ করব।
গতকাল শনিবার বিকেলে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে এই পাইপলাইনের উদ্বোধন শেষে তিনি এ কথা বলেন। পাইপলাইনটি উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে তেল আসা শুরু হলো। ভারতের নুমালিগড় থেকে শিলিগুড়ি হয়ে ১৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইনে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত ডিজেল আনা হবে।
ভারতের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম তিন বছর বার্ষিক দুই লাখ টন করে, পরের তিন বছর তিন লাখ টন করে, পরের চার বছর পাঁচ লাখ টন করে এবং পরবর্তী বছরগুলোতে বার্ষিক ১০ লাখ টন করে জ্বালানি ভারত থেকে বাংলাদেশে আসবে।
ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম আন্তঃসীমান্ত জ্বালানি তেলের পাইপলাইন। এটি নির্মাণে খরচ হয়েছে আনুমানিক ৩৭৭ কোটি রুপি। বাংলাদেশ অংশে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৮৫ কোটি রুপি। ভারত সরকার থেকে এ আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে। বার্ষিক ১ মিলিয়ন টন
পরিবহনে সক্ষম এ পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সাতটি জেলায় প্রাথমিকভাবে ডিজেল সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া সৈয়দপুরে তেলভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ডিজেল সরবরাহ করা হবে।
উদ্বোধনকালে গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও তার জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্য ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। দুই প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ভারতের আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া ভারত সরকারের অন্য কর্মকর্তারাও যুক্ত ছিলেন।
দুই দেশের মধ্যকার সহযোগিতা আরও গভীর হচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিগত বছরগুলোতে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনাকে আমরা বাস্তবে রূপদান করেছি। আমাদের দুই দেশের মধ্যে সমস্যাগুলো একে একে আমরা সমাধান করেছি। যোগাযোগ স্থাপন করেছি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার আমরা ঘটিয়েছি। আমরা উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি এবং ভারতের কাছ থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা পাচ্ছি। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও উভয় দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি। দুই দেশের জনগণের কল্যাণে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে পারস্পরিক সহযোগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।’
তিনি বলেন, আমাদের দুই দেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক, সেটাই আমরা চাই। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে, সেটা আমরা কার্যকর করতে চাই। ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঠিক রেখে দুই দেশের জনগণের সার্বিক উন্নয়নে আমরা কাজ করে যেতে চাই। আমরা চাই আমাদের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হোক।
ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বাংলাদেশে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। আমি চাই ভারতের বিনিয়োগকারীরাও এখানে বিনিয়োগ করুক। আমরা দুই দেশই তাতে লাভবান হবো। ভারত থেকে বাংলাদেশের ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে উপ-আঞ্চলিক পর্যায়সহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার আরও কয়েকটি উদ্যোগ বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। বাংলাদেশের এই উন্নতিতে পাশে থাকতে পেরে আমরা খুশি। এই পাইপলাইন বাংলাদেশের উন্নতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। দুই দেশের মধ্যে কানেকটিভিটি যত বাড়বে তত দুই দেশের লোকজনের মধ্যে সম্পর্ক জোরালো হবে বলেও উল্লেখ করে মোদি বলেন, কভিড মহামারির পরও এই প্রজেক্টের কাজ চালিয়ে যাওয়ায় আমরা খুশি। এই পাইপলাইনের কল্যাণে খরচ কমার পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণও কম হবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনের উপকার হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা মেঘনা পেট্রোলিয়ামের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ এ পাইপলাইনে ৪৭ লাখ লিটার বা চার হাজার ৭০০ টন তেল সব সময় সংরক্ষিত থাকবে। শিলিগুড়ি প্রান্ত থেকে নতুন তেল দিয়ে চাপ দিলেই পার্বতীপুর প্রান্তে পাইপের তেল বেরিয়ে ছাঁকনি প্রক্রিয়া শেষে ডিপোতে জমা হবে। এজন্য পার্বতীপুরে আগে থেকেই বিপিসির ১৫ হাজার টন তেল মজুত করার মতো ট্যাঙ্কার রয়েছে। নতুন করে সেখানে আরও ছয়টি ট্যাঙ্কার নির্মাণ করা হচ্ছে, যার ধারণ ক্ষমতা ২৯ হাজার টন।
২০২০ সালে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ভারতের নুলাইবাড়ি রিফাইনারি লিমিটেড থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর তেল ডিপো পর্যন্ত ১৩১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানোর পরিকল্পনা করা হয়, যার মধ্যে ভারতের অংশে রয়েছে পাঁচ কিলোমিটার আর বাংলাদেশের অংশে ১২৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার।
২০১৭ সাল থেকে নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে রেলওয়ের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় ২২০০ টন ডিজেল আমদানি করছে বিপিসি। ট্রেনে করে এ তেল পার্বতীপুরের ডিপোতে পৌঁছতে সময় লাগে এক মাস। তবে পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ভারত থেকে পার্বতীপুর রেল ডিপোতে ডিজেল আসতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এতে পরিবহন খরচ অনেকটাই কমে যাবে। চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে ১৫ বছর ডিজেল আনতে পারবে বলে জানিয়েছে বিপিসি।
বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যে তেল কেনা হচ্ছে তাতে ব্যারেলপ্রতি প্রিমিয়াম প্রাইস পড়ছে ১১ ডলার। এ পাইপলাইনের মাধ্যমে খরচ পড়বে ৫ দশমিক ৫০ ডলার। দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদার বড় অংশই হলো ডিজেল। প্রতিবছর প্রায় ৩৬ লাখ টন ডিজেল আমদানি করা হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। স্পট মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে তেল ও এলএনজি গ্যাস কেনা বন্ধ করে দেয় সরকার। এমন অবস্থায় ভারত থেকে কম খরচে জ্বালানি তেল আমদানির চলমান সংকট নিরসনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাইপলাইনের কাজ উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি।