দুলাল হোসেন
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৩, ০৮:০৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পুরান ঢাকার ৮০ শতাংশ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ

পুরান ঢাকার ৮০ শতাংশ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ

রাজধানীর পুরান ঢাকা একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। সেখানে ২৫ হাজার ভবন আছে, যার ৯০ শতাংশের কোনো অনুমোদন নেই। আবার যেসব ভবন আছে, সেগুলোর প্রায় ৮০ শতাংশই আছে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনার তালিকায়। তার পরও সেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভবন নির্মাণ হচ্ছে, সেগুলোও পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। পুরান ঢাকাকে নিরাপদ বাসযোগ্য করতে হলে প্রায় ৮০ শতাংশ ভবন ভেঙে ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুযায়ী নির্মাণ করতে হবে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। পুরান ঢাকার ঝুঁকি ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করেছেন এমন কয়েকজন নগর বিশেষজ্ঞ কালবেলাকে বলেছেন, পুরান ঢাকায় এখন আধুনিক ভবন নির্মাণ হচ্ছে, তবে পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করতে হবে পরিকল্পিতভাবে। তা না হলে সেখানে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতিসাধন হতে থাকবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের নগর পরিকল্পনা শাখার প্রধান মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তাতে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজারের বেশি স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ভবন আছে একতলা বিশিষ্ট।

বাকি ভবনগুলো দোতলা থেকে শুরু করে বহুতল। পুরান ঢাকায় যেসব ভবন রয়েছে তার ৯০ শতাংশের বেশি অনুমোদন নেই। সেখানকার ৮০ শতাংশের বেশি স্থাপনায় একসঙ্গে চলে আবাসিক-বাণিজ্যিক কার্যক্রম। ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) ২০১০-১৫-এ পুরান ঢাকার কিছু এলাকাকে মিক্সড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা আছে; কিন্তু সে এলাকার বাসিন্দারা বেশিরভাগ এলাকাকে মিক্সড জোন হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।

তিনি বলেন, ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট ড্যাপ ২০২২-৩৫-এর গ্রেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন ড্যাপের প্রস্তাবনা অনুযায়ী পুরান ঢাকার উন্নয়নে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের নাম হচ্ছে নগর পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় পুরান ঢাকার সাতটি এলাকাকে নির্বাচন করা হয়েছে। এখন এর সমীক্ষা কার্যক্রম চলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশই নগর পুনঃউন্নয়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরিকল্পিত নগরায়ণ থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমাদেরও পরিকল্পিতভাবেই এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. এমদাদুল ইসলাম বলেন, পুরান ঢাকা একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। ২০০৩ সালে শাঁখারীবাজারে ভবনধসের পর পুরান ঢাকাকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন পুরান ঢাকাকে বসবাসযোগ্য শহরে পরিণত করতে করণীয় ঠিক করতে গণপূর্তমন্ত্রীকে প্রধান করে একটি উচ্চপর্যায়ে কমিটি গঠন করে সরকার। ওই কমিটি আবার রাজউক, সিটি করপোরেশন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর এই সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে। আমরা যারা কমিটিতে ছিলাম তারা সরেজমিনে পুরান ঢাকার পরিদর্শন করে সে এলাকাকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন দাখিল করি।

প্রতিবেদনে কী ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ৯০০ ভবন চিহ্নিত করে সেগুলো ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করার তালিকা দিয়েছি। নতুন ভবন নির্মাণকালে কমপক্ষে ২০ ফুট রাস্তা রাখার কথা বলেছি। ছোট প্লটগুলো কয়েকটি একত্রিত করে একটি ভবন নির্মাণ করার কথা বলেছি। আমাদের প্রতিবেদনটি আমলারা মানতে চাননি, তখন তারা বলেছিলেন এ কাজ সম্ভব নয়। এরপর আমরা আর কোনো মিটিংয়ে যাইনি। ফলে অপরিকল্পিত পুরান ঢাকাকে পরিকল্পিত বানানোর যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটি মূলত কাগজ-কলমের কাজ ছিল। বাস্তবে কিছুই হয়নি। সেটি হলে পুরান ঢাকার চেহারা অনেক পাল্টে যেত। আমরা ২০ বছর আগে যে প্রস্তাব করেছিলাম, ২০২২-৩৫ প্রকাশিত ড্যাপে তাই বলা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, পুরান ঢাকার ৮০ শতাংশ ভবন বিভিন্ন মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় বড় ধরনের ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ড ঘটলে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষতিসাধন হবে। এর থেকে রক্ষা পেতে হলে পুরান ঢাকাবে বাসযোগ্য নিরাপদ শহরে পরিণত করতে হলে সেখানকার ৮০ শতাংশ ভবন ভেঙে সড়ক প্রশস্তকরণসহ অন্যান্য কমপ্লায়ন্স ঠিক রেখে নির্মাণ করতে হবে। অলিগলিতে অনেক আধুনিক ভবন নির্মাণ হচ্ছে। সেগুলো পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। নতুন ভবনগুলো হয়তো দেখতে সুন্দর হচ্ছে; কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটলে তাতে কোনো কাজ হবে না। সেখানে প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষতিসাধন হতেই থাকবে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একই ভবনে রয়েছে শিল্পকারখানা, রাসায়নিক দাহ্য পদার্থসহ বিভিন্ন মালপত্রের গুদাম, দোকান ও আবাসিক ফ্ল্যাট। অলিতে গলিতে গড়ে উঠছে রাসায়নিকের গুদাম, কারখানা, প্লাস্টিক, পলিথিন কারখানা ও দোকান। এসব প্রতিষ্ঠানে আগুন নেভানোর নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রয়োজনীয় রাস্তার অভাবে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে না। অনেক সময় অগ্নিকাণ্ডস্থলের কাছে জলাধার না থাকায় পানির অভাবে ফায়ার সার্ভিসকে বেগ পেতে হয়।

নগর পরিকল্পনাবিদ ইনস্টিটিউট ফর প্লানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, পুরান ঢাকার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকি হচ্ছে কেমিক্যাল। সেখানকার বেশির ভাগ বাড়িতে কেমিক্যালের দোকান ও গোডাউন রয়েছে। পুরান ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ স্থাপনা ঝুঁকিপূর্ণ। একসঙ্গে তো এলাকার রি-ডেভেলপমেন্ট করা সম্ভব না। এতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। এত অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। তাই প্রথমত ঝুঁকি কমাতে কেমিক্যালের গোডাউন ও দোকান সরাতে হবে। সেখান সার্ভিস লাইনগুলো ঠিক করতে হবে। এর পাশপাশি এলাকার রাস্তা প্রশস্তকরণসহ অন্যান্য কাজ করতে হবে। ধীরে ধীরে পুরান ঢাকাকে রি-ডেভেলপমেন্ট করতে হবে।

জানা গেছে, নতুন ড্যাপে পুরান ঢাকার বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সংকীর্ণ রাস্তা, উচ্চ ঘনবসতি, জরাজীর্ণ ইমারত, নাগরিক সুবিধাদির অপ্রতুলতা ইত্যাদি পুরান ঢাকার চলমান সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধানে ড্যাপের সুপারিশে বলা হয়—ভবনে মিশ্র ব্যবহার থাকলে তলার সংখ্যা যাই হোক না কেন, বাধ্যতামূলকভাবে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ১০ ফুট প্রশস্ততার নিচে সব রাস্তায় যানবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ কারণে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরি করতে হবে।

সরকারি জমি, খাল, পুকুরগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে, যা স্বাভাবিক সময়ে পাবলিক স্পেস হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং অগ্নিকাণ্ডের সময়ে ফায়ার হাইড্র্যান্ট হিসেবে কাজ করবে। নতুন নির্মিত আবাসিক ভবনের ছাদের ওপর পানির ট্যাঙ্কের পাশাপাশি ফায়ার হাইড্র্যান্ট ট্যাঙ্ক স্থাপনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়া ভবনের সেটব্যাকের জন্য ছেড়ে দেওয়া জায়গায়ও ফায়ার হাইড্র্যান্ট ট্যাঙ্ক স্থাপন করতে হবে। ভবনের ব্যবহৃত সিঁড়িতে কোনো মালপত্র রাখা যাবে না। এসব দেখভাল করতে রাজউক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সমন্বয়ে যৌথ ভিজিল্যান্স টিম গঠন করা যেতে পারে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বৈদ্যুতিক খুঁটিতে প্রাইভেটকারের ধাক্কা, কৃষকলীগ নেতা নিহত

৬০ হাজার টাকা বেতনে ওয়ার্ল্ড ভিশনে চাকরি

আ.লীগ লুটপাট করে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর করেছে : রিজভী

কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা

ইন্টারনেট ছাড়াই ছবি-ফাইল পাঠানো যাবে হোয়াটসঅ্যাপে

নেট দুনিয়ায় ভাইরাল বিমানবালাকে পাইলটের বিয়ের প্রস্তাব

‘হিট অ্যালাট’ এর মেয়াদ বাড়ল

গাজায় জিম্মি ইসরায়েলির ভিডিও প্রকাশ

আ.লীগ নেতা টিপু হত্যা / অভিযোগ গঠনের বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল

‘টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশেই থাকবে’

১০

দিনাজপুরে ইসতিসকার নামাজ আদায়

১১

হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে বিশ্রামে তেভেজ

১২

৪৬তম বিসিএস প্রিলি শুক্রবার, যেসব নির্দেশনা মানতে হবে

১৩

দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীকে হত্যা

১৪

যমুনা গ্রুপে ডিরেক্টর পদে চাকরি, সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন

১৫

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জামায়াতের ইসতিসকার নামাজ

১৬

ছন্দ হারানো মোস্তাফিজকে ‘চাচার’ পরামর্শ!

১৭

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি নিয়ে আসছে নতুন সিদ্ধান্ত

১৮

শরীয়তপুরে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ

১৯

২৩৮ জনের বড় নিয়োগ দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়

২০
*/ ?>
X