বিএনপি-জামায়াত দূরত্ব আসল নাকি কৌশল

বিএনপি ও জামায়াতের দলীয় লোগো।
বিএনপি ও জামায়াতের দলীয় লোগো।

দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে বিএনপির। দলীয় সূত্র বলছে, রাজনৈতিক কৌশলের কারণেই জামায়াতের সঙ্গে এ দূরত্ব। দলের হাইকমান্ডের পর্যবেক্ষণ–বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের জোটবদ্ধ আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনি। বরং ক্ষমতাসীনদের প্রচারণায় ‘বিএনপি-জামায়াত’ সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। তাই জামায়াতকে দূরে রেখে সমমনাদের নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। তবে ভোটের সমীকরণে জামায়াতকে নিয়ে কৌশলী ও সতর্ক বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকদের আশঙ্কা, আগামী নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে পারে জামায়াত। পরে সরকার বিএনপির বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহারও করতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির তৃণমূলের নেতাদের মতে, চলমান আন্দোলন সফল করতে জামায়াতের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

জানা গেছে, বহুদিন পর গত ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় এবং ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার বাইরে যুগপৎ আন্দোলনে নিজেদের অবস্থান জানান দেয় জামায়াত। সেদিন ঢাকার মালিবাগে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এর পরই ফের আলোচনায় আসে তারা। সম্প্রতি যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতের অংশগ্রহণ না থাকা এবং নিজস্ব আঙ্গিকে কর্মসূচি পালন করায় রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুগপৎ কর্মসূচির শুরুতে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরাও পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন। অনেকের নামে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছেন অনেকে। গত ডিসেম্বরে দলটির আমিরকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। তবে এ নিয়ে বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এ অবস্থায় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, তাহলে বিএনপি কি জামায়াতকে এড়িয়ে চলছে? এই দুই দলের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটা কি আসল না কৌশল? তবে রাজনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকদের মতে, অবশেষে বিএনপি-জামায়াত দূরত্ব তৈরি হয়েছে! অবশ্য বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে নারাজ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (সাবেক) ড. নূরুল আমিন বেপারি কালবেলাকে বলেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, জামায়াত-বিএনপির সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কৌশলগত কারণে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছে বিএনপি।

তিনি আরও বলেন, শুরুর দিকে জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন করেছে। তাদের অনেক নেতাকর্মী আহত ও গ্রেপ্তার হয়েছেন; কিন্তু এ নিয়ে বিএনপি কোনো বিবৃতি বা বক্তব্য দেয়নি। যে কারণে জামায়াত ক্ষুব্ধ। বহির্বিশ্বও মনে করছে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে নেই। আর বিএনপি নিজেরাই শক্তিশালী আন্দোলন করতে চায়। তবে বিএনপি কঠোর আন্দোলন করতে পারলে শেষ পর্যন্ত জামায়াতও জেগে উঠবে। আর নির্বাচন হলে জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাবে বলে মনে হয় না। বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে গেলে জামায়াত বেইমান দল হিসেবে পরিচিতি পাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়তে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট গঠিত হয়, যা পরে ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। জামায়াত নেতারা জানান, ২০০১ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে চারদলীয় জোট। সেই সরকারের মন্ত্রিসভায় জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করলে জামায়াতের আমির বা শীর্ষ কোনো নেতা তার পাশে বসতেন। এমনকি তিনি জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগও রক্ষা করতেন; কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বিএনপি এখন প্রকাশ্যে কোনো জোট বা যোগাযোগ না রাখলেও মনে মনে চায় জামায়াত তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকুক।

সরকারবিরোধী চলমান যুগপৎ আন্দোলন সামনে রেখে ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া হয়। অবশ্য গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ওই জোটের ১২টি দলের সমন্বয়ে ‘১২ দলীয় জোট’ এবং ২৮ ডিসেম্বর আরও ১১টি দল মিলে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট গঠিত হয়। তাতেও জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। বরং গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতও পৃথক কর্মসূচি পালন করেছে।

আরও জানা যায়, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়। বর্তমানে সেই দূরত্ব যেন বিচ্ছেদের পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর যে যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে, এর শুরুর দিকের দুটি কর্মসূচিতে জামায়াতের অংশগ্রহণ ছিল। এরপর থেকে নিজেদের মতো করে কর্মসূচি পালন করছে দলটি। এ পর্যন্ত যুগপতের ৯টি কর্মসূচি হয়েছে। অষ্টম ও নবম কর্মসূচি হিসেবে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জেলায় জেলায় পদযাত্রা এবং ৪ মার্চ দেশের ১৩টি সাংগঠনিক মহানগরীর থানায় থানায় পদযাত্রা কর্মসূচি হয়েছে। এ কর্মসূচিতেও জামায়াত অংশ নেয়নি।

জামায়াতের কয়েকজন নেতা জানান, বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি ‘ক্ষোভ’ এবং ‘অভিমান’ থেকেই এ অবস্থার সূত্রপাত। যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি অন্য সব দলের সঙ্গে আলোচনা করলেও জামায়াতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। এর পরও অনেকটা আগ বাড়িয়ে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে গত বছরের ২৪ ও ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলে অংশ নেয় জামায়াত। এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর রাতে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর যুগপতের গণমিছিল করতে গিয়ে মালিবাগে জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার ও আহত হন। এ নিয়ে বিএনপির কোনো নেতা বক্তব্য বা বিবৃতি দেননি। এমনকি যুগপতের পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে কোনো আলোচনাও করেনি। কার্যত এর পরই জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে।

তবে নিজস্ব কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপির আগে বা পরে মাঠে তৎপর রয়েছে জামায়াত। যদিও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত বিএনপির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তবে জামায়াত মনে করছে, বিএনপি ভেবেছে নানা কারণেই বর্তমান সরকারের ওপর মানুষ ক্ষুব্ধ। ফলে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতকে ছাড়াই বিএনপি সফল হতে পারবে। এ কারণে যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বিএনপির হাইকমান্ড।

এদিকে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, সরকারের হিংসাত্মক কার্যক্রম, সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, নিত্যপণ্যসহ প্রতিটি জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কোনো বিরোধী দল রাস্তায় না নেমে চুপ থাকতে পারবে না। এরই মধ্যে সব বিরোধী দল রাজপথে সক্রিয় রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীও বর্তমান সরকারের কাছ থেকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এ অবস্থায় দলটির জন্য মাঠে সরকারবিরোধী কট্টর অবস্থান নেওয়ার বিকল্প নেই।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে চাই। জামায়াত বর্তমান জুলুমবাজ সরকারের পতনের লক্ষ্যে ১০ দফা দাবিতে কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলনে আছে। তবে যুগপতের গণমিছিলের পর বিএনপি তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো কথা বলেনি, এমনকি বৈঠকও করেনি। তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের কৌশলে আন্দোলনে আছি। বিএনপি যোগাযোগ করলে আমরা সাড়া দেব।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, কৌশলগত কারণেই জামায়াতকে সঙ্গে রেখেছিল বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির আরেকজন সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, এখন আর ২০ দলীয় জোট নেই। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর যে যার অবস্থান থেকে যুগপতের কর্মসূচি পালন করছে। জামায়াতের সঙ্গে ওটা ছিল নির্বাচনী জোট। তারা আমাদের মন্ত্রিসভায়ও ছিল। এখন যে যেভাবে পারছে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা জামায়াতের সঙ্গে আগের মতো যোগাযোগ করছি না।

দৈনিক কালবেলার চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চলমান যুগপৎ আন্দোলনে চট্টগ্রামে বিএনপি ছাড়া আর কোনো দল মাঠে নেই। যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচিতে মাঠে নেমেছিল জামায়াত-শিবির। এরপর পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে প্রতিটি কর্মসূচিতে মিছিল বের করে দলটির নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘির জেলা পরিষদ মার্কেট চত্বর থেকে জামালখান প্রেস ক্লাব পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিলের আবেদন করে নগর জামায়াত। তবে পুলিশের অনুমতি পায়নি তারা।

চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর বলেন, আমরা আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি। প্রতিটি কর্মসূচিতে মানুষের ঢল নামছে। অন্য কোনো দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই। জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম নগর আমির মুহাম্মদ শাহজাহান ও সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমীন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সভা-সমাবেশ করতে বাধা দিচ্ছে। এমনকি দলের কার্যালয়ও খুলতে দিচ্ছে না।

নগর জামায়াতের মজলিশে শূরা ও কর্মপরিষদ সদস্য এসএম লুৎফর রহমান বলেন, আমরা বিএনপির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছি। এজন্য দলের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির দড়ি পরতে হয়েছে। কারাগারে বন্দি আছেন অনেকে। কারও লেজ ধরে আন্দোলন না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল। নিজস্ব গতিতে নিজস্ব কর্মসূচি দেব আমরা।

এদিকে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক ‘আশেক আর মাশুক’ উল্লেখ করে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, তারা একজন ছাড়া অন্যজন অচল। জামায়াত-শিবির নিয়ে বিএনপি নেতাদের মুখে তালা লাগিয়ে কিছু বলতে না চাওয়ার অভিনয় করা একটা রাজনৈতিক কৌশল। দেখবেন, নির্বাচনের আগে তারা ঠিকই জোট করবে, আসন ভাগাভাগি করবে।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com