শীর্ষ শত ঋণগ্রহীতায় ঝুঁকি বাড়ছে ব্যাংক খাতের

বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক।পুরোনো ছবি

শীর্ষ ১০০ গ্রহীতার কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি চারটি ব্যাংকের সিংহভাগ ঋণ। এর বড় অংশই আবার বকেয়া বা অনাদায়ী। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের মাত্র কয়েকজন গ্রাহকের বকেয়া ঋণের পরিমাণ পুরো ব্যাংক খাতের শীর্ষ ১০০ গ্রহীতার মোট বকেয়ার ২৪ শতাংশ। সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা এভাবে কিছু ঋণগ্রহীতার কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ায় পুরো ব্যাংকিং খাতেই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বড় গ্রহীতার কাছে ব্যাংকগুলোর ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ১০০ ঋণগ্রহীতার কাছে বকেয়া ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৩০ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে শীর্ষ ১০০ ঋণগ্রহীতার কাছে বকেয়া ঋণ এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবসময় অনেক বেশি।

কোনো ব্যাংক তার বিতরণকৃত মোট ঋণের কত শতাংশ অর্থ বড় গ্রাহকদের দিতে পারবে, তা ব্যাংক কোম্পানি আইন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রীতিনীতিতে স্পষ্ট করা আছে। ব্যাংককে অল্প কিছু গ্রাহকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতেই এমন বিধান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের অধিকাংশ ব্যাংকে এই নিয়ম প্রতিপালন হয়নি। বরং এসব ব্যাংকের সবকটিরই ঋণ পোর্টফোলিওতে বড় গ্রাহকদের দেওয়া ঋণের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘন হয়েছে।

আইন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও জনতা ব্যাংক তার ঋণ পোর্টফোলিওর ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বড় ঋণ দিতে পারে। যদিও গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪৯ শতাংশই ছিল বড়দের কাছে। আর বড় গ্রাহকদের কাছে গেছে জনতা ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর ৬৯ শতাংশ অর্থ। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকও বড় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘন করেছে। অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর ৩৬ শতাংশ অর্থ নিয়েছেন বড় গ্রাহকরা। যদিও এ ক্ষেত্রে ব্যাংকটির বড় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা হলো পোর্টফোলিওর ৩০ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের বড় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ৩৪ শতাংশ হলেও ব্যাংকটি এরই মধ্যে ৩৬ শতাংশ অর্থ বড়দের দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শীর্ষ ১০০ ঋণগ্রহীতার তালিকাভুক্ত গ্রাহকের ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় নিবিড় মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে উৎপাদনশীল খাতে ঋণ বিতরণ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম কালবেলাকে বলেন, এটা নতুনভাবে দেওয়া কোনো ঋণ নয়, আগে থেকেই ছিল। সোনালী ব্যাংকের বড় ঋণগ্রহীতাদের বেশিরভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের বৃহৎ ব্যাংক হিসেবে আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি ঋণপত্রের পাশাপাশি ঋণের জোগান দিচ্ছি। ফলে এখানে এটা থাকতেই পারে। তবে এটা স্থায়ী নয়, চলমান প্রক্রিয়া। তবে যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে আগে থেকেই কেন্দ্রীভূত ঋণ রয়ে গেছে, তা আদায়ে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছি। আর আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নতুনভাবে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়নি। কারণ, বর্তমানে ঋণ বিতরণে সিএসএমই ও কৃষি খাতকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ব্যাংকের এজিএম ও ডিজিএমদের ঋণ বিতরণের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এভাবে আমরা সোনালী ব্যাংকের ঋণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভাব ও অদক্ষতায় ব্যাংকগুলোতে এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এটা এড়াতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ও উৎপাদনশীল খাতে নতুন নতুন ব্যাংকিং উপাদান তৈরির মাধ্যমে ঋণ বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, আমাদের দেশে ঋণ কেন্দ্রীভূতকরণ একটি বড় সমস্যা। এ ছাড়া অনেক ঋণ হিসাবের মধ্যে আসে না। কারণ, এখন অধিকাংশ ঋণ নেওয়া হয় বেনামে। নামে-বেনামে কিছু গ্রাহককে ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে। ফলে ঋণ কেন্দ্রীভূতকরণের আসল চিত্র পাওয়া যায় না। তারপরও যেটুক পাওয়া যায়, সেখানেই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেখা যায়। ঋণ কেন্দ্রীভূতকরণের পাশাপাশি ব্যাংকের মালিকানাও কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ একই পরিবার বা শিল্পগোষ্ঠী অনেক ব্যাংকের মালিক হয়ে পড়ছে। ফলে তারা অন্যায়ভাবে নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে নামে-বেনামে ঋণ নিচ্ছে, যা হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রশ্রয়, সুশাসন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবেই এমনটা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি কাটাতে হলে সবার আগে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন করে এসব প্রতিবেদন দিলেও তা ড্রয়ারে আটকে থাকবে। ফলে আগামী দিনে ব্যাংকব্যবস্থায় আরও বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড়দের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি রাতারাতি হয়নি। বরং বছরের পর বছর ধরেই এ প্রক্রিয়া চলছে। বিশেষ করে গত ১০ থেকে ১২ বছরে এটি অনেক বেশি ত্বরান্বিত হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মালিকানা ও পরিচালনা পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে। ব্যাংকগুলোর পর্ষদে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিও রয়েছেন। তারপরও বড়দের কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার বিষয়টি ঠেকানো সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শীর্ষ ১০০ ঋণগ্রহীতার বকেয়া ঋণ আছে—এমন শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তালিকা অনুযায়ী, শীর্ষ ১০টি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকেয়া ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়েছে ইসলামী ব্যাংকে। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ১০০ ঋণগ্রহীতার তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ৫৫ হাজার ৬১২ কোটি টাকা বা ৩৮ শতাংশ। একইভাবে সোনালী ব্যাংকে ৩০ শতাংশ, জনতা ব্যাংকে ২৪ শতাংশ এবং ন্যাশনাল ব্যাংকে ২৪ শতাংশ বকেয়া ঋণই শীর্ষ ১০০ ঋণগ্রহীতার। একইভাবে অগ্রণী ব্যাংকে ১২ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংকে ১৫ শতাংশ, সাউথইস্ট ব্যাংকে ১৮ শতাংশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে ১৩ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকে ১৩ শতাংশ এবং পূবালী ব্যাংকে ১২ শতাংশ ঋণ ১০০ ঋণগ্রহীতার কাছে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ কেন্দ্রীভূতকরণের হার অনেক বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকে শীর্ষ ১০০ ঋণগ্রহীতার কাছে বকেয়া ঋণের ২৫ শতাংশ, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ৭১ শতাংশ এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোতে ৪ শতাংশ ঋণ রয়েছে। আলোচ্য সময়ে আগের তিন মাসের তুলনায় ১০০ ঋণগ্রহীতার কাছে বকেয়া ঋণের পরিমাণ ন্যাশনাল ব্যাংকে ৩৮ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংকে ২৮ শতাংশ এবং অগ্রণী ব্যাংকে ২১ শতাংশ বেড়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, শীর্ষ ১০ ঋণগ্রহীতার কাছে বকেয়া ঋণের পরিমাণ শীর্ষ ১০০ ঋণগ্রহীতার মোট বকেয়া ঋণের ২৮ শতাংশ।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ কেন্দ্রীভূতকরণের বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, এটা তো কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানে বেশি পরিমাণে ঋণ বিতরণ করার কারণেই এমন সমস্যা তৈরি হতে পারে। ব্যাংকগুলো হয়তো বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে ঋণ না দিয়ে বড় বড় করপোরেট গ্রুপকে বেশি ঋণ দেয়। এটা ঝুঁকি বিবেচনায় ভুল নীতি। এর কারণেই এ সমস্যা তৈরি হয়ে থাকতে পারে। এটা কখনোই হওয়া উচিত নয়। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকেরই দেখা উচিত। কেননা তদারকির অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে এই ঝুঁকি পরিমাপ করা। তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ঝুঁকি নিরূপণের মাধ্যমে কেন্দ্রীভূতকরণ ঝুঁকি নিরূপণ করে থাকে। তিনি বলেন, ব্র্যাক ব্যাংক এসএমই খাতে ৫০ শতাংশের বেশি এবং ১৭ শতাংশ রিটেইল ব্যাংকিং খাতেসহ ঋণ বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করে। ফলে এই ব্যাংকে কখনোই ঋণ কেন্দ্রীভূতকরণের সমস্যা হয়নি। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সব ব্যাংককে একই পদ্ধতি অবলম্বনের পরামর্শ দেন তিনি।

প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ২৬টি ব্যাংকের ১৮ জন ঋণগ্রহীতার কাছে ৬ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুঞ্জীভূত রয়েছে। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের তিন গ্রাহকের কাছে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩৯১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কেন্দ্রীভূত আছে, যা ব্যাংকটির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। গত ডিসেম্বর ভিত্তিতে শীর্ষ ১০০ বকেয়া ঋণের তালিকা পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব গ্রাহকের কাছে খেলাপি ঋণ পুঞ্জীভূত হয়ে পড়েছে, তা আদায়ে ব্যাংকগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে—তা আগামী ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানাতে বলা হয়েছে।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com