বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
শেখ হারুন
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৩, ১২:১৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যমুনা নদী ছোট করার চিন্তা

যমুনা নদী ছোট করার চিন্তা

যমুনা নদী প্রতি বছর বড় হয়ে যাচ্ছে। বর্ষার সময় নদীটি ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার হয়ে যায়। এত বড় নদীর প্রয়োজন নেই। তাই এটির প্রশস্ততা সাড়ে ৬ কিলোমিটার সংকুচিত করা হবে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং প্রাকৃতিক পানি প্রবাহের অন্যতম উৎস যমুনাকে ছোট করার এমন আইডিয়া এসেছে খোদ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের মাথা থেকে। এজন্য তারা ১১শ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও প্রণয়ন করেছেন। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে যখন বারবার ব্যয় সংকোচনের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে, সে সময় মন্ত্রণালয়টি এমন প্রকল্প নিয়েছে কোনো ধরনের গবেষণা ছাড়াই। বিশেষজ্ঞরা বিরল এ প্রকল্পকে অবাস্তব বলছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদী ছোট করতে যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাংলাদেশ তো বটেই—পৃথিবীর কোনো দেশেই আগে প্রয়োগের নজির নেই। এ কারণে প্রকল্পটি নিয়ে খোদ সরকারের ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের একটি পক্ষ বলছে, কোনো ধরনের জরিপ ছাড়া ঋণের টাকায় এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো যৌক্তিকতা নেই। প্রকল্পের বিরোধিতা করে নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের প্রকল্প নেওয়া ঠিক হবে না, এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের আশঙ্কা রয়েছে। বাড়তে পারে বন্যা প্লাবনের ঝুঁকি। পাশাপাশি এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দেশের অন্যতম স্থাপনা পদ্মা সেতু এবং যমুনা সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সম্প্রতি যমুনা নদীর প্রশস্ততা কমাতে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। গত ৬ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পের ওপর পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একেএম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে কমিশনের বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধি এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা পিইসি সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় এ ধরনের আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়। সভায় এই প্রকল্পে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাব করা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।

পিইসি সভা সূত্রে জানা গেছে, যমুনা নদীর তীর রক্ষা এবং ঝুঁকি প্রশমনে টেকসই অবকাঠামো শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ভাঙন রোধে গাইবান্ধার ফুলছড়ি এবং টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলায় যমুনা নদীতে টপ ব্লকড পারমিয়েবল গ্রোয়েন (টিবিপিজি) অর্থাৎ বাঁধ নির্মাণ করে প্রশস্ততা সাড়ে ৬ কিলোমিটার সংকুচিত করা হবে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ১০৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৮৯৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আর বাংলাদেশ সরকার দেবে ২১৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে চলতি বছর থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত।

জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা দপ্তর) ড. শ্যামল চন্দ্র দাস কালবেলাকে বলেন, বর্ষার সময় যমুনা নদী ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার হয়ে যায়। এত বড় যমুনা নদীর প্রয়োজন নেই। যেহেতু এত বড় নদীর দরকার নেই, তাই নদীটাকে ছোট করতে (প্রস্থে) একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে ধরা হয়েছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই হলো যমুনা নদী ব্যবস্থাপনা এবং নদীর প্রশস্ততা কমানো। যমুনা নদীর ফ্লো (প্রবাহ) কীভাবে কমানো যায় সেটি দেখা হবে। তিনি বলেন, পাইলট প্রকল্প করে দেখা হবে নদী কতটুকু কমানো যায়। এটি আসলে ধারাবাহিকভাবে কমানো হবে। প্রথমে ছোট আকারে শুরু হবে। যদি টেকসই হয় তাহলে পরে বড় আকারে প্রকল্প নেওয়া হবে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, এটি একটি অযৌক্তিক প্রকল্প। এত বড় নদীতে কোনো প্রকার স্টাডি ছাড়া এ ধরনের প্রকল্প করা যায় না। ইচ্ছেমতো গ্রোয়েন দেওয়া যায় না। যমুনা নদীতে এসব ছেলেখেলা করা যাবে না। স্টাডি ছাড়া এটি করলে কোথায় কী ভাঙবে, এর প্রভাব কী হবে সেটি কি জানে তারা। রাষ্ট্রের টাকায় এভাবে অপচয় করা ঠিক হবে না।

গ্রোয়েনের ফলে কী ধরনের প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হবে। গ্রোয়েনের ফলে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। এই অবকাঠামো নির্মাণের ফলে একদিকের পানি অন্যদিকে নিয়ে যাবে। তার ফলে ডাউনস্ট্রিমে ভাঙন দেখা দিতে পারে। মাছের ওপর প্রভাব পড়বে। ভ্যালোসিটি বেড়ে যাবে। এর ফলে কী ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে সেটি আগে গবেষণা করতে হবে। এগুলো প্রতিকারে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেসব স্টাডি করে তারপর প্রকল্প নেওয়ার চিন্তা করতে হবে। হুট করে নিলেই হবে না। তাদের এত জ্ঞানী-গুণী বিশেষজ্ঞ থাকতে কীভাবে তারা এই প্রকল্প নিল, সেটিই বুঝি না।

সরকারের মধ্যেও প্রশ্ন :

শুধু বিশেষজ্ঞরা নন, এই প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এমনকি প্রকল্প প্রস্তাবের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। পিইসি সভায় পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান মো. ছায়েদুজ্জামান বলেন, এ প্রকল্পে নতুন প্রযুক্তি টিবিপিজির মাধ্যমে নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। তবে যথাযথ স্টাডি ছাড়া ঋণের টাকায় এমন একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু তা স্পষ্ট নয়। এমনকি ইতোপূর্বে পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়নি।

জবাবে প্রকল্প প্রস্তাবকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, যেহেতু যমুনা নদীর প্রশস্ততা প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেহেতু তা কমানোর জন্য এ ধরনের প্রযুক্তির বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংক প্রাথমিকভাবে ৩টি স্থানের প্রস্তাব করা হলেও তা কমিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে নদীর দুই পাড়ে গ্রোয়েন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম প্রধান (সেচ) এনামুল হক বলেন, ডিপিপিতে বলা হয়েছে টিবিপিজির প্রস্তাবিত স্থানে কোনো রিসার্কুলেটিং ফ্লো তৈরি হবে না অথচ নদীগর্ভে ৫ স্তর বিশিষ্ট জিও-ব্যাগ ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটিতেই স্পষ্ট হয়, যথাযথ স্টাডি না করেই গ্রোয়েন নির্মাণে ডিজাইন করা হয়েছে। তিনি বলেন, যমুনা নদীর মরফোলজি দ্রুত পরিবর্তনশীল ও প্রশমন ঝুঁকিপূর্ণ। প্রকল্প স্থানে যে টিবিপিজি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা ব্যর্থ হতে পারে। যদি তাই হয়, তাহলে বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে এ ধরনের পাইলটিং প্রকল্পের যৌক্তিকতা কি জানতে চান তিনি।

তিনি বলেন, টিবিপিজির মাধ্যমে নদী সংকোচনের ফলে যে সমস্ত এলাকায় নদী প্রবাহ থাকবে না সেসব এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে কৃষি, মৎস্য সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভবিষ্যতে যমুনা নদীর ডাউনস্ট্রিমের পরিবেশ এবং যমুনা সেতু ও পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য স্থাপনার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়।

এমনকি এই প্রকল্প প্রস্তাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান মো. আবু নাসার উদ্দিন বলেন, এ প্রকল্পে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। প্রকল্পে ৫ হাজার গাছ লাগানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, গাছগুলো কোথায় লাগানো হবে এবং কী ধরনের গাছ লাগানো হবে তা ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়নি।

পিইসি সভায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় যমুনা নদীতে নেভিগেশন সচল রাখার জন্য সিরাজগঞ্জ থেকে ভারতের দইখোলা পর্যন্ত ২০০ কিলোমিটা নৌ-পথ সচল রাখার জন্য ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করবে। যমুনা নদীতে পলি পড়ার হার অত্যন্ত বেশি হওয়ায় শুধুমাত্র ড্রেজিং দ্বারা এর নাব্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। তবে যমুনা নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে আনা সম্ভব হলে তখন নাব্য রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এবার চিপকেও ব্যর্থ মোস্তাফিজ

বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব নিলেন ডা. আতিকুর

চাঁদপুরে টাউন হল মার্কেটে আগুন

নারী বিশ্বকাপের ভেন্যু দেখতে সিলেটে আইসিসির প্রতিনিধি দল

সুদের ওপর কর অব্যাহতি পেল অফশোর ব্যাংকিং

এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় বাচসাস’র নিন্দা

চবিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ কর্মীকে মারধর

ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে প্রবাসীর স্ত্রী থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ

সেতুমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়ায় শাহবাগ থানায় জিডি

পদ্মা ব্যাংকের এমডির পদত্যাগ

১০

আদাবরে স্ত্রীর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার, স্বামী পলাতক

১১

ভর্তি পরীক্ষায় জবিতে থাকবে ভ্রাম্যমাণ পানির ট্যাংক

১২

অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি, বিপাকে পুলিশ কনস্টেবল

১৩

গরমে বেড়েছে ডায়রিয়া, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ৮৩

১৪

একাধিক অন্তরঙ্গ ভিডিও ভাইরাল, কে এই তরুণী

১৫

‘পরকীয়ার জেরে’ হত্যা করা হয় মিতুকে : মা

১৬

গাজার সেই শহরে আবারও নারকীয় হামলার ঘোষণা

১৭

রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদে 

১৮

যেসব জেলায় শিলাবৃষ্টির আশঙ্কা

১৯

‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার’

২০
*/ ?>
X