মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু সাধারণত বর্ষা মৌসুমে ছড়ানোর কথা। তবে বাংলাদেশে এখন আর এটি নির্দিষ্ট সময়ে সীমাবদ্ধ থাকছে না। জলবায়ু পরিবর্তন ও মশকনিধনে উদাসীনতার কারণে সারা বছরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষ। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে এর ভয়াবহতা। প্রতি বছরই ভাঙছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড। মশা নিধন কার্যক্রম গতানুগতিক পদ্ধতিতে আটকে থাকায় এ বছর ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আগের চেয়ে বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার দ্বিগুণ। গত বছর প্রথম চার মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় ১১ জনের। চলতি বছরের চার মাসে এই সংখ্যা ২৪। চলতি মাসের প্রথম ৯ দিনে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন আরও পাঁচজন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার বৃষ্টি মৌসুম দীর্ঘ হতে পারে। আর সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, বৃষ্টির মৌসুম দীর্ঘ হলে আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর ঝুঁকি রয়েছে। লম্বা সময় ধরে সংক্রমণ চলতে থাকলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে ডেঙ্গু মৌসুম দীর্ঘ হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নভেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত ঘটছে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, এবারও গতবারের চেয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়ংকর হতে পারে।’
এদিকে মশাবাহিত রোগটি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে প্রতিবেশী দেশ কলকাতা, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া। স্থানীয় সরকার বিভাগ, জনসম্পৃক্ততা ও প্রযুক্তির কল্যাণে তিনটি মডেল সফল হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে গত দুই যুগ ধরে রোগটি ভয়ংকর রূপ ধারণ করলেও প্রতিরোধে কোনো মডেল তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা হয়নি। জোর দেওয়া হচ্ছে শুধুই চিকিৎসায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থায় জোর দিয়ে মশাবাহিত ডেঙ্গু মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এজন্য বাহক (মশা) নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে। মশার বংশবিস্তার রোধ করতে হবে। মশার বংশবিস্তারের উৎস খুঁজে ধ্বংস করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা কিংবা সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় সফল মডেলের আদলে একটি কর্মকৌশল তৈরি করে কাজ করতে হবে।
কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার কালবেলাকে বলেন, ‘কলকাতা ও আমাদের আবহাওয়া প্রায় একই রকম। সেখানে তারা একটি জনসম্পৃক্ত মডেল প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করে মশা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপও কমে এসেছে। অথচ আমরা দুই যুগেও মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। উল্টো শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়েছে।’
ডেঙ্গু মোকাবিলায় তিনি নিজেও একটি মডেল (কেবি মডেল) তৈরি করেছেন। সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কেবি মডেল নামে একটি মডেল তৈরি করেছি। আগামী পাঁচ বছরের একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে মডেলটি বাস্তবায়ন করা হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও তার দুই প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।’
মশক নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার বিভাগ ব্যর্থ হলে এর দায় এসে পড়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ওপর। অতিরিক্ত রোগী সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের। গত বছর অতিরিক্ত ডেঙ্গু রোগীর চাপে শিরায় পুশ করা স্যালাইন সংকট দেখা দিয়েছিল। এতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তুতি নিয়েও বিতর্ক ওঠে। এবার ডেঙ্গু রোগী সামলাতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
আগের মতো এবার শিরায় পুশ করা স্যালাইন সংকট হবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে জরুরি রোগী ছাড়া অন্য রোগী ভর্তি না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। গত বছরের মতো এবার স্যালাইন সংকট হবে না। দেশের ওষুধ উৎপাদকদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তারা আশ্বস্ত করেছেন, মূল্য বৃদ্ধি ছাড়াই সরকারকে প্রয়োজনীয় স্যালাইন সরবরাহ করবেন। তবে ডেঙ্গু মোকাবিলায় চিকিৎসাসেবার চেয়ে মশকনিধনে বেশি জোর দিতে হবে।’
ডেঙ্গু চিকিৎসায় সরকারের প্রস্তুতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. শেখ দাউদ আদনান কালবেলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। ডেঙ্গু শনাক্তকরণের ১২ লাখ কিট মজুত রয়েছে। সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে এসব কিট সরবরাহ করা হচ্ছে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রণীত জাতীয় চিকিৎসা গাইডলাইন অনুসারে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। হাসপাতালের শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে।’
তবে গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তাদের মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা (ডেথ রিভিউ) এখনো শেষ করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত বছরের মাঝামাঝিতে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কাজটি হয়নি বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ডেথ রিভিউকে আমরা দুর্ঘটনায় নিহতের পোর্স্টমর্টেমের সঙ্গে তুলনা করে থাকি। ডেথ রিভিউয়ের মাধ্যমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তি কী ধরনের শারীরিক জটিলতার কারণে মারা গেছেন, তা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে নিজেদের দুর্বলতা ও পরবর্তী চিকিৎসা কৌশল নির্ধারণ সহজ হবে।’
এ বিষয়ে ডা. দাউদ আদনান বলেন, ‘গত বছরের ডেথ রিভিউ শিগগির শেষ করা হবে।’
এই চিকিৎসক জানান, ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার আক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
বছর বছর বাড়ছে শনাক্ত-মৃত্যু:
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু দুদিক থেকেই প্রতি বছর রেকর্ড হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০০ সালে ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। এরপর ২০০১ সালে ২ হাজার ৪৩০ জন, ২০০২ সালে ৬ হাজার ৩৩২, ২০০৩ সালে ৪৮৬, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৯৩৪, ২০০৫ সালে ১ হাজার ৪৮, ২০০৬ সালে ২ হাজার ২০০, ২০০৭ সালে ৪৬৬ জন, ২০০৮ সালে ১ হাজার ১৫১, ২০০৯ সালে ৪৭২, ২০১০ সালে ৪০৯, ২০১১ সালে ১ হাজার ৩৫৯, ২০১২ সালে ৬৪১ জন, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৭৪৯, ২০১৪ সালে ৩৭৫, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ১৬২, ২০১৬ সালে ৬ হাজার ৬০, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৭৬৯, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮, ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪, ২০২০ সালে ১ হাজার ৪০৫, ২০২১ সালে ২৮ হাজার ৪২৯, ২০২২ সালে ৬১ হাজার ৮৯, ২০২৩ সালে ৩ লাখ ২১ হাজার ২ এবং চলতি বছরের ৯ মে পর্যন্ত ২ হাজার ৩৯১ জন আক্রান্ত হন।
মৃত্যুর হিসাবে দেখা গেছে, ২০০০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৯৩ জন। এরপর ২০০১ সালে ৪৪, ২০০২ সালে ৫৮, ২০০৩ সালে ১০, ২০০৪ সালে ১৩, ২০০৫ সালে ৪, ২০০৬ সালে ১১ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে কারও মৃত্যু হয়নি। আবার ২০১১ সালে মৃত্যু হয় ছয়জনের। ২০১২ সালে একজন, ২০১৩ সালে দুজন, ২০১৪ সালে কারও মৃত্যু হয়নি। ২০১৫ সালে ছয়জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে ১৪ জন, ২০১৭ সালে আটজন, ২০১৮ সালে ২৬ জন, ২০১৯ সালে ১৭৯ জন, ২০২০ সালে সাতজন, ২০২১ সালে ১০৫ জন, ২০২২ সালে ২৮১ জন, ২০২৩ সালে ১ হাজার ৭০৫ এবং গত ৯ মে পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে জলবায়ু তথা বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা সম্পৃক্ত। ২০০০ সাল থেকে যদি পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখব, গত ২৩ বছরে ধীরে ধীরে ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়েছে। অথচ ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাজধানীর বিত্তশালী এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল। এখন কিন্তু সেখানে সীমাবদ্ধ নেই।’
রোগটি মোকাবিলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্য যে, গত ২৩ বছরেও রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। মূলত ঘাটতি রয়েছে কারিগরি জ্ঞান, লোকবল ও দক্ষতায়। কলকাতা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদদের সমন্বয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে। তারা কোথাও এডিস মশার উপস্থিতির খবর পেলে দ্রুত সেখানে সমন্বিত দল পাঠিয়ে অনুসন্ধান করে যে, কীভাবে এই মশার উৎপত্তি হলো। এ দেশে এমন কোনো উদ্যোগ নেই। একটি জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এই রোগের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হবে।’