তিন বছর আগে দেশের সব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এক বছরের মধ্যে ৬ লাখ কমিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় সারা দেশে ৩৭ লাখ মামলা বিচারাধীন ছিল। এরপর তিন বছর পার হলেও মামলাজট তো কমেনি, উল্টো ৬ লাখ বেড়ে গেছে।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের বিচারাধীন মামলার স্তূপ পৌঁছেছে ৪৩ লাখে। এর মধ্যে অধস্তন আদালতগুলোয় ৩৭ লাখ ৩০ হাজার মামলা বিচারাধীন ছিল। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলা প্রায় ৬ লাখ। ২০১২ সালে বিচারাধীন মামলা ছিল ২১ লাখ ৩৫ হাজার। এক যুগের ব্যবধানে বিচার বিভাগে মামলার জট বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আর ২০০৭ সালের নভেম্বরে বিচার বিভাগ পৃথককরণের সময় বিচারাধীন মামলা ছিল মাত্র ১৫ লাখ। অর্থাৎ পৃথককরণের পর ১৬ বছরে মামলার জট ২৮ লাখ বেড়েছে।
মামলাজট কমানোর সেই ঘোষণার কথা মনে করিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সোমবার কালবেলাকে বলেন, ‘মামলাজট কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
এ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি আইনমন্ত্রী।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিদ্যমান আইনি জটিলতা ও পারিপার্শ্বিক নানা কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা জটিল আকার ধারণ করেছে। কোনো কোনো মামলার বিচার নিষ্পত্তিতে বিচারপ্রার্থীকে এক যুগ, দুই যুগ—এমনকি তিন যুগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বিচার বিলম্বের কারণে একদিকে মামলা পরিচালনার ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে ভোগান্তি। কিছু কিছু মামলার বাদী বিচার শেষ হওয়ার আগেই মারা যাচ্ছেন। আবার বিচার হলেও দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলার অনেক তথ্য-প্রমাণ হারিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো মামলার সাক্ষী মারা যাচ্ছেন। কিছু মামলার সাক্ষীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কারণে বিচার শেষে সাজার হার কমে যাচ্ছে। বহু বছরের পুঞ্জীভূত সমস্যা বর্ধিত হয়ে বর্তমানে অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে। শুধু বিচার বিলম্বের কারণে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার লাভের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে বলেও মনে করছেন অনেকেই।
তারা বলছেন, বিচার বিভাগের এই সংকট এড়াতে হলে পরিকল্পিত উপায়ে দ্রুত নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় বিচার বিভাগে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখা দেবে।
গত ১ মার্চ এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘যে পরিমাণ বিচারক সারা বাংলাদেশে থাকা দরকার সেই পরিমাণ বিচারক নেই। দেশে ৯০ থেকে ৯৫ হাজার মানুষের জন্য একজন বিচারক। এত কম বিচারক দিয়ে মামলাজট কমানো সম্ভব নয়। এই সংখ্যাটা বাড়াতে হবে। লজিস্টিক সাপোর্টসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মামলাজট নতুন কিছু নয়, এটা পুরোনো ব্যাধি। মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সেজন্য মামলাজট বাড়ছে। মানুষ লেখাপড়া যত শিখছে, এতে মনে হয় মানুষ এক ধরনের অস্থিরতায় ভুগছে। এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে হবে, বোঝাতে হবে শুধু মামলা-মোকদ্দমাই সমাধান নয়, বিকল্প ব্যবস্থা আছে। আগে গ্রামের সালিশ ছিল। আইন করে সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেটাকে যদি জনপ্রিয় করা যায়, তাহলে মামলাজট কিছুটা কমবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালত পর্যন্ত সর্বত্র মামলাজট বেড়েই চলেছে। বিচারকের সংখ্যা বাড়িয়েও কোনো লাভ হয়নি। কারণ বিচারকের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মামলা দায়েরের সংখ্যা। ২০০৮ সালে আপিল বিভাগে বিচারপতি ছিলেন সাতজন। তখন বিচারাধীন মামলা ছিল ৬ হাজার ৮৯২টি। এরপর আপিল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা আর কোনো দিন সাতের নিচে নামেনি। বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা আটজন। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মামলা ছিল ২৬ হাজার ৫১৭টি।
একইভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগেও মামলার সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ২০০৮ সালে এ বিভাগে মামলা বিচারাধীন ছিল ২ লাখ ৯৩ হাজার ৯০১টি। তখন হাইকোর্টে বিচারপতির সংখ্যা ছিল ৬৭ জন। ২০১০ সালের পর এ বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা কখনো ৯০-এর নিচে নামেনি। কিন্তু মামলাজট ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে ৮৪ জন বিচারপতি দায়িত্বরত রয়েছেন। আর এই বিভাগে বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৪৭টি।
একই চিত্র সারা দেশের অধস্তন আদালতেও। ২০০৭ সালের নভেম্বরে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সময় অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারক ছিলেন ৩০১ জন। বিপরীতে বিচারাধীন মামলা ছিল প্রায় ১৩ লাখ। বর্তমানে ২ হাজারের বেশি বিচারকের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ১৮শ। আর অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলা ৩৭ লাখ ২৯ হাজার ২৩৫টি।
এসব তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে একজন বিচারকের বিপরীতে গড়ে প্রায় ২৩শ মামলা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক আদালতের পরিস্থিতি আরও খারাপ। কিছু কিছু আদালতে একজন বিচারকের আওতায় ৫ হাজারের বেশি মামলা রয়েছে। আবার একজন বিচারককে একাধিক আদালতেরও দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে বিচারকদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে মামলার চাপ সামাল দিতে। আর এ কারণে অনেক মামলার শুনানির তারিখ ধার্য হচ্ছে ৬ থেকে ৮ মাস পরপর। আবার অনেক সময় ধার্য তারিখে শুনানি না করেই তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এভাবেই বেড়ে যাচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, জনসংখ্যা অনুপাতে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিচারকের সংখ্যা কম। গড়ে প্রায় ৯৫ হাজার লোকের বিপরীতে একজন বিচারক দায়িত্ব পালন করেন। যেখানে ভারতে আনুমানিক ৪৭ হাজার ৬১৯ জনের বিপরীতে একজন, পাকিস্তানে ৫০ হাজার, অস্ট্রেলিয়ায় ২৪ হাজার ৩শ, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার এবং যুক্তরাজ্যে প্রতি ৩ হাজার ১৮৬ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন বিচারক দায়িত্ব পালন করেন।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক মামলাজট প্রসঙ্গে বলেন, ‘মামলাজট কমাতে হলে বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিচারকের সংখ্যা বাড়লে নিষ্পত্তি বেড়ে যাবে। সরকার এজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে আইন কমিশন থেকে বিস্তরিত প্রতিবেদন দেওয়ায় তিনি বেশি কিছু বলতে চাননি।
আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক কালবেলাকে বলেন, ‘মামলাজটের পেছনে প্রধান কারণ হলো, সরকারের কাছে বিচার বিভাগ একেবারেই অবহেলিত। একটা ফ্লাইওভার করতে সরকার যতটা গুরুত্ব দেয়, বিচার বিভাগের প্রতি তার চেয়েও কম গুরুত্ব দেয়। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিকের উন্নতি কীভাবে হবে, তা বলা আছে। কিন্তু সেখানে বিচার বিভাগ সম্পর্কে কিছুই বলা নেই। মামলাজট বাড়ছে এটা যদি গুরুত্বপূর্ণ হতো, তাহলে সরকারের পরিকল্পনায় এটা স্থান পেত।’
ড. শাহদীন মালিক আরও বলেন, ‘১৮শ বিচারক দিয়ে ১৭ কোটি মানুষের বিচার করা অসম্ভব। আর এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এ খাতে বরাদ্দ পর্যায়ক্রমে পাঁচ হাজার কোটিতে উন্নীত করতে হবে। প্রতি বছর গড়ে একশজনের মতো বিচারক নিয়োগ হচ্ছে, সেটা তিনশতে উন্নীত করতে হবে। সেইসঙ্গে বিচারকদের পর্যাপ্ত সহকারী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। আর এসব কাজে শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছাই যথেষ্ট।’
মামলা জট কমানো প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ও বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মো. শাহজাহান সাজু কালবেলাকে বলেন, ‘কোনো কিছু বাস্তবায়ন সম্ভব কি না সেটা বিবেচনায় না নিয়েই মন্ত্রী-এমপিরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। আইনমন্ত্রীও একই উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মামলার জটও বেড়ে যাচ্ছে। এটা কমাতে হলে বিচারক এখন যা আছে, তার তিনগুণ বাড়াতে হবে। কম করে হলেও পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।’
আইন কমিশনের সুপারিশ:
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও জট কমিয়ে আনার বিষয়ে সুপারিশ করে গত বছর আগস্টে আইন কমিশন একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে জটের মূল পাঁচটি কারণ উল্লেখ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে, পর্যাপ্ত বিচারক না থাকা, বিশেষায়িত আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না হওয়া, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা, জনবলের অভাব এবং দুর্বল অবকাঠামো। অন্য কারণগুলো হলো মামলা সুষম বণ্টন না হওয়া, প্রশাসনিক শৈথিল্য, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না হওয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীর জবাবদিহির অভাব, আইনজীবীর আন্তরিকতার অভাব, দুর্বল মামলা ব্যবস্থাপনা, জমিজমা-সংক্রান্ত নথি সংরক্ষণের অভাব, প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যবহারিক জটিলতা, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, ক্রমাগত শুনানির অভাব, যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, নকল সরবরাহে অনিয়ম, উচ্চ আদালত কর্তৃক নথি তলব, সংশ্লিষ্ট মামলার আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিভিশন, মোকাদ্দমা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ইত্যাদি।
মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা কমাতে কয়েকটি সুপারিশও করে আইন কমিশন। এর মধ্যে আছে মামলা দায়ের করার সময় মিথ্যা, ফলহীন ও হয়রানিমূলক মামলা করার বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। নালিশি মামলা গ্রহণের ক্ষেত্রে মামলার আবেদনকারী ব্যক্তির (ফরিয়াদি) অভিযোগ যাচাইয়ের মাধ্যমে মামলার রক্ষণীয়তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলা হলে বাদীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনের ২১১ ধারার আওতায় মামলা করার বাধ্যবাধকতা আনতে হবে এবং দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এতে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রবণতা কমবে এবং মামলার সংখ্যা অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে পদ সৃষ্টি করে কমপক্ষে পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগ করা হলে জট কমিয়ে মামলার সংখ্যা সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে। তবে রাষ্ট্রের সীমিত সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্বল্প সময়ে এত বিচারক নিয়োগ করা সম্ভব নয়। আবার একসঙ্গে এত বিচারক নিয়োগ করলে তাদের গুণগত মানেরও অবনতি ঘটতে পারে। তবে ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর কমপক্ষে পাঁচশ বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে মতামত দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশে আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে মামলা জট নিরসনে কার্যকর ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে বিচার ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে। আইন কমিশন মনে করে, মামলা জট নিরসনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে এক বা একাধিক সমস্যা ও তার প্রতিকারের প্রতি নজর না দিয়ে সামগ্রিকভাবে গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক।