একীভূতকরণের ডামাডোলে মূলত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে বহুল আলোচিত ব্যাংকটির শতভাগ শেয়ার বেসরকারি সিটি ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করবে সরকার। সিটি ব্যাংকের আগ্রহের ভিত্তিতে একীভূতকরণের এই ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সরকারের কোনো পর্যায়েই এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক এবং নীতি সহায়তা পাওয়া যাবে—এমন আশা থেকেই দুর্দশাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংক অধিগ্রহণ করতে চায় বেসরকারি সিটি ব্যাংক। গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করেন সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিন। সেখানেই বেসিক ব্যাংক অধিগ্রহণের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ ব্যাংকও সিটি ব্যাংকের এ আগ্রহকে সমর্থন দিয়েছে।
তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি ব্যাংক কীভাবে বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান যে প্রক্রিয়ায় একীভূত হয়, বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে সেটি সম্ভব নয়। কারণ, একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় প্রথমে নিরীক্ষার মাধ্যমে দুর্বল প্রতিষ্ঠানের দায়-দেনা ও সম্পদমূল্য নির্ধারণ করা হবে। তার ভিত্তিতে ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডাররা বৃহৎ বা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের কী পরিমাণ শেয়ার পাবেন, তা নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের শতভাগ শেয়ার সরকারের হাতে। সেক্ষেত্রে সিটি ব্যাংকের বর্তমান মালিকরা সরকারকে কোনো শেয়ার দেবে কি না কিংবা সরকার ওই ব্যাংকের শেয়ার নেবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘বেসিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের মতো অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিচালিত হয় না। তবে ব্যাংকটির শতভাগ শেয়ার ধারণ করে সরকার। তাই সরকার যদি চায়, তাহলে যে কোনো সময় সেই শেয়ার ছেড়ে দিতে পারে।’
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার নতুন করে কোনো ব্যাংকের শেয়ার নেবে বলে মনে হয় না। আবার সিটি ব্যাংকের মালিকরাও সরকারকে অংশীদার হিসেবে চাইবে না। ফলে মুখে একীভূতকরণ বলা হলেও সিটি ব্যাংক মূলত বেসিক ব্যাংকের শতভাগ শেয়ার অধিগ্রহণ করবে। সেক্ষেত্রে দায়দেনার পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকটির সম্পদের মালিকানা চলে যাবে সিটি ব্যাংকের কাছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংককে অন্য কোনো সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ না করে কেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কাছে দেওয়া হচ্ছে, সেটি একটি মুখ্য প্রশ্ন। এটা কি আসলে হোলসেল প্রাইভেটাইজেশন বা নির্বিচার বেসরকারীকরণের অংশ? তার মানে, আগামীতে সোনালী, জনতা, অগ্রণী এবং রূপালী ব্যাংককেও হয়তো একই দিকে ঠেলে দেওয়া হতে পারে, যা মোটেও কাম্য নয়।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংক আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই নীতি চালু করতে চায়। তাদের কর্তৃত্বে যে নব্য উদারবাদ নীতি চলছে, তার একটি উল্লেখযোগ্য নীতি হলো, সব কিছু উদারহস্তে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দাও। আমরা সেই ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি কি না, সেটি ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। যদিও সেটা কখনোই কোনো দেশের জন্য ভালো ফল দেয় না। আমাদের ক্ষেত্রেও যদি সেটা হয়ে থাকে, তা মোটেও ভালো সমাধান হবে না।’
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলেও মালিকানা পরিবর্তনের বিষয়ে এখনো বেসিক ব্যাংককে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, মাসখানেক আগে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল হাশেমের সঙ্গে মার্জারের সম্ভাবনা নিয়ে বৈঠক করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সেখানে বেসিক ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে বেসিক ব্যাংকের পক্ষ থেকে একীভূত না করে তারল্য সহায়তা চাওয়া হয় ।
সর্বশেষ গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত সভায় কোনো বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
যোগাযোগ করা হলে বেসিক ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু মো. মোফাজ্জল কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংককে বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করা হচ্ছে—গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে কেউ কোনো আলোচনা করেনি। অথচ গণমাধ্যমের মার্জারের সংবাদ আসার পর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেসিক ব্যাংক থেকে তাদের বড় অঙ্কের আমানত তুলে নিচ্ছে। গত কয়েকদিনে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার আমানত তুলে নিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান, যা বেসিক ব্যাংকের জন্য অনেক বড় ক্ষতি। তারা বলছে, যেহেতু বেসিক ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাচ্ছে, তাই তারা তাদের আমানত আর বেসিক ব্যাংকে রাখতে চায় না। এ বিষয়টিই পরিচালনা পর্ষদে তুলে ধরা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ বিষয়টি উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার (আজ) অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হবে। এর অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরেও দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু বেসিক ব্যাংক শতভাগ সরকারি একটি ব্যাংক। তাই এ বিষয়ে সরকারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা শুধু আমাদের ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরছি।’
বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকটির ১০৭টি শাখার মধ্যে ছয়টি বাদে সবই লাভজনক। ঋণ বিতরণে লাগাম টানা, পুরোনো ঋণ আদায় জোরদার করা ও খরচ কমিয়ে ব্যাংকটি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যদিও উচ্চ সুদের আমানত থাকায় এখনো তারল্য সংকট রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি বন্ড সুবিধার আওতায় তারল্য সহায়তা দিলে বেসিক ব্যাংক এক বছরেই লাভজনক হতে পারবে বলে গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে আশা প্রকাশ করা হয়।
জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী বা অগ্রণীর সঙ্গে বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিডিবিএল (বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) অধিগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। এরই মধ্যে দুই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একীভূতকরণ প্রস্তাব অনুমোদনও করেছে। এরপর বেসিক ব্যাংককে অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই ব্যাংকটিকে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের কাছে ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অবশ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন কালবেলাকে বলেন, ‘সিটি ব্যাংকের সঙ্গে অন্য কোনো ব্যাংকের মার্জারের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে স্বপ্রণোদিত একত্রীকরণ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নীতি সহায়তা যেহেতু অনেক বেশি, তাই সবল ব্যাংক হিসেবে কোনো দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করা যায় কি না—তা আমরা খতিয়ে দেখছি।’
তিনি বলেন, ‘সিটি ব্যাংকের জন্য একীভূতকরণ মডেল ভিন্ন হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচিত ব্যাংক প্রথমে পুনর্গঠন করা হবে। তারপর ব্যালেন্স শিট একীভূত হবে তিন থেকে পাঁচ বছর পরে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে সিটি ব্যাংকের মোট ঋণ ৩৯ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা খেলাপি। অর্থাৎ সিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার বিতরণকৃত মোট ঋণের ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। ব্যাংকটির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির মোট আমানত ছিল ৩৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ২০২৩ সাল শেষে বেসিক ব্যাংকের মোট ঋণ ১২ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকার মধ্যে ৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা খেলাপি, যা মোট ঋণের ৬৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল ৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে মোট আমানত ছিল ১৪ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা।
আর্থিক অবস্থানের দিক থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে থাকা এই দুই ব্যাংকের একীভূতকরণের উদ্যোগকে ভালোভাবে দেখছেন না অনেক অর্থনীতিবিদ। তারা বলছেন, এভাবে জোর করে একটি ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক মার্জ করালে ভালো ব্যাংকটিও খারাপ হয়ে যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘সংস্কারের কথা বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জোর করে যেভাবে ব্যাংক মার্জ করছে, সেটি মোটেও ভালো কোনো কাজ হচ্ছে না। এতে দুর্বল ব্যাংকের দায় নিতে গিয়ে ভালো ব্যাংকগুলোও খারাপ হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া বেসিক একটি সরকারি ব্যাংক। আর সিটি বেসরকারি খাতের ব্যাংক। ফলে দুটি ব্যাংকের কাজের ধরন এবং সম্পদের ধরনও আলাদা। এর মাধ্যমে সরকার একরকম বেসিক ব্যাংকের দায় থেকে অব্যাহতি পেতে চাইছে।’
এদিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে না দিয়ে বেসিক ব্যাংককে সরকারি কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে বলা হয়েছে, শতভাগ রাষ্ট্র মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকে অন্যান্য রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের অনুরূপ চাকরি বিধিমালা অনুসরণ করা হয়, যা বেসরকারি মালিকানার ব্যাংকের সঙ্গে পুরোপুরিভাবেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী বেসিক ব্যাংককে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেড নির্ধারণ এবং বেতন ও অন্যান্য ভাতা দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাদের পেনশন সুবিধাও চালু রয়েছে। শ্রম আইন অনুযায়ী, সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেসিক ব্যাংকে সরকারি শ্রম অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত ও রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ বিষয়গুলোর সঙ্গে বেসরকারি কোনো ব্যাংকের সামঞ্জস্য নেই। এ অবস্থায় বেসরকারি মালিকানাধীন সিটি ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক মার্জারের বিষয়ে যে আলোচনা হয়েছে, তা একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অযৌক্তিক।’