
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে রাজধানীর গুলিস্তানের পাশে সিদ্দিকবাজার। মাঝে নিউমার্কেট এলাকার সায়েন্সল্যাব। ব্যবধান মাত্র চার দিনের। ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল একেকটি এলাকা। বিধ্বস্ত হলো ভবন, আছড়ে পড়ল ছাদ, দেয়াল, দরজা-জানালা ও আসবাব। সব মিলিয়ে প্রাণ গেল ২৭ জনের। আহত-দগ্ধ হলেন কয়েকশ মানুষ।
ঢাকার দুই ঘটনার কারণ সম্পর্কে সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো বলছে, ভবনে জমে থাকা গ্যাসের চাপে ঘটেছে এমন ভয়বাহ বিস্ফোরণ। পুলিশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিথেন গ্যাসের কারণে এই বিস্ফোরণ হতে পারে। আর সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরিত হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। তবে ধারাবাহিক এই বিস্ফোরণের ভয়াবহতা দেখে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। অনেকের সন্দেহ, এসব বিস্ফোরণের নেপথ্যে অন্য কিছু নেই তো?
গতকাল বুধবার গুলিস্তানে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদও এই বিস্ফোরণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, বিস্ফোরণের ঘটনা প্রকৃত দুর্ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক কিছু, তার সঠিক তদন্ত প্রয়োজন।
কয়েক বছর আগেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে। তাই সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে উল্লেখ করে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, কী কারণে এমন ধারাবাহিক বিস্ফোরণ, সীতাকুণ্ড, ঢাকার সায়েন্সল্যাব, এখন সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। এ ঘটনাগুলো কোনো কিছুর ইঙ্গিত কি না, সেটাও গোয়েন্দাদের দেখতে হবে। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ ঘটনার প্রকৃত কারণ বের করতে হবে। কোনো বিস্ফোরক নাকি রাসায়নিক থেকে এ ঘটনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
সাধারণ মানুষের সন্দেহটা আরও বড় হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতার বক্তব্যে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ধারাবাহিক এসব ঘটনাকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখতে নারাজ। গতকাল দলীয় কার্যালয়ে এক যৌথ সভায় তিনি বলেন, ‘এসব রহস্যজনক ঘটনার পেছনের কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা বা দলের সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। নাশকতামূলক ঘটনা ঘটানো হচ্ছে কিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা সিরিয়াসলি খতিয়ে দেখছেন।’
গুলিস্তানে বিস্ফোরণের পর এক বিবৃতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এসব বিস্ফোরণের ধরন প্রায় একই রকম হওয়ায় জনমনে সন্দেহ বাড়ছে। এসব ঘটনা পরিকল্পিত কি না, তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
অবশ্য গুলিস্তানে বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে। তবে এখনো বিস্ফোরকের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।’ সায়েন্সল্যাবে বিস্ফোরণের পর পুলিশ কমিশনার অভিন্ন তথ্য দিয়েছিলেন।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দীন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটা নিছক দুর্ঘটনা। তার পরও তদন্ত চলছে। তদন্তের পর পরিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।’
গত মঙ্গলবার বিকেলে গুলিস্তানের অদূরে সিদ্দিকবাজার এলাকায় সাততলা একটি ভবনের বেজমেন্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এতে ওই ভবনটি বেজমেন্ট থেকে তিনতলা পর্যন্ত ছাদ এবং দেয়াল দুমড়েমুচড়ে যায়। পাশের পাঁচতলা ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে ১৯ জন প্রাণ হারান, আহত হন দেড় শতাধিক ব্যক্তি। এর আগে গত রোববার সায়েন্সল্যাব এলাকায় তিনতলা একটি ভবনে প্রায় একইভাবে বিস্ফোরণ হয়। এতে ভবনটি বিধ্বস্ত হয়ে তিনজন প্রাণ হারান, আহত হন অর্ধশত ব্যক্তি। ওই বিস্ফোরণেও আশপাশের ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শনিবার সীতাকুণ্ডে শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন উৎপাদন কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৬ জন প্রাণ হারান। আহত-দগ্ধ হন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি।
তিনটি ঘটনাই বিস্ফোরণস্থল থেকে আশপাশের এলাকা কেঁপে ওঠে। গুলিস্তানে বিস্ফোরণের পর প্রায় এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় ভবন কেঁপে ওঠে। বিকট শব্দে আতঙ্ক ছড়ায়। একই অবস্থা হয় সায়েন্সল্যাব এলাকায় বিস্ফোরণেও। সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে লোহার আঘাতে প্রাণ যায় এক ব্যক্তির। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণকে ‘জমে থাকা গ্যাস’ থেকে হয়েছে বলা হলেও সাধারণ মানুষ তাতে সন্দিহান। তদন্ত শেষ না করেই ‘দুর্ঘটনা’ অবহিত করায় ‘কিছু লুকানো হচ্ছে কি না’ ঘটনাস্থলে সেই প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।
গুলিস্তান ঘটনার পর অন্তত আধা কিলোমিটার দূরে সুরিটোলা এলাকায় পাইপ-টিউবের ব্যবসায়ী আসলাম হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘ভয়াবহ শব্দ। গোটা এলাকাটা কেঁপে উঠল। মনে হলো দুনিয়াটা ভেঙে যাচ্ছে, সব ভবন ধসে পড়ছে।’ তার ভাষ্য, জমে থাকা গ্যাসে এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন দুটির অদূরে আলুবাজারের বাসিন্দা ইদ্রিস আলীও বলছেন, যেভাবে ঘটনাটা ঘটল, তাতে মনে হয় না গ্যাস জমে এটা হতে পারে। ঘটনাটা ভয়াবহ ছিল।
কতটা ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছে তা বোঝা যায় উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ঢাকা বিভাগ) দিনমনি শর্মা ও উপসহকারী পরিচালক মো. শাহজাহান শিকদারের ভাষ্যে। এই দুই কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, সাততলা ভবনটির বেজমেন্ট থেকে তিনতলা পর্যন্ত ছাদ ওপরের দিকে উঠে গম্বুজের মতো হয়ে গেছে। পিলারগুলোর ইট-সুড়কি খসে গেছে। পাশের পাঁচতলা ভবনটিরও একই অবস্থা। এটা ভয়াবহ বিস্ফোরণ ছিল।
জমে থাকা গ্যাসে এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ হতে পারে কি না জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান কালবেলাকে বলেন, বদ্ধঘরে বা কক্ষে গ্যাস জমতে পারে। জমে থাকা এই মিথেন গ্যাসের সঙ্গে অক্সিজেনের উপস্থিতি থাকলে দহনের কারণে বিস্ফোরণ হওয়া স্বাভাবিক।
গ্যাসের প্রেশারটা কতটুকু ছিল, সে অনুযায়ী বিস্ফোরণের মাত্রা নির্ভর করে জানিয়ে রসায়নের এই অধ্যাপক বলেন, ‘কিন্তু গুলিস্তানে যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হলো, সায়েন্সল্যাব এলাকায় যে বিস্ফোরণটা হলো, জমে থাকা গ্যাসে এত ভয়াবহতা কীভাবে ছড়াল, তা বোধগম্য নয়। এটা সন্দেহজনক। বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার।’
বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে ছুটে যায় পুলিশ ও র্যাবের বোমা ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বোম্ব ডিসপোজাল বিভাগের প্রধান এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, যে কোনো উপায়েই হোক ভবনের আবদ্ধ কক্ষে গ্যাস জমেছিল। সেখানে শর্টসার্কিট বা অন্য কোনো উপায়ে স্পার্ক থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে।
এই বিস্ফোরণ কোনো নাশকতা নয় জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো বিস্ফোরক বা আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) সার্কিটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কোনো বিস্ফোরক ব্যবহার হলে কোনো রঙিন বা কালো ধোঁয়া হয়। কিন্তু সেখানে এমন কোনো আলামত মেলেনি।
র্যাবের বোম্ব ডিজপোজাল ইউনিটের প্রধান মেজর মশিউর রহমান জানান, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে বিস্ফোরণটি ভবনের বেজমেন্ট থেকে হয়েছে। এটা স্বাভাবিক কোনো বিস্ফোরণ নয়। গ্যাস জমে কিংবা অন্য কোনোভাবে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এ ঘটনা এসি থেকে ঘটেনি এটা নিশ্চিত হয়েছি।