
ফাতেমা খাতুন গত বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রসব বেদনা নিয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, তার নরমাল ডেলিভারি করানো হবে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেও ওয়ার্ডের নার্সরা নরমাল ডেলিভারি করতে ব্যর্থ হন। রাত ৮টার দিকে নার্সরা টেবিলের ওপর মৃত নবজাতক রেখে বলেন, আপনাদের একটি মৃত বাচ্চা হয়েছে। এ সময় নবজাতকের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন দেখতে পান বলে অভিযোগ করেন প্রসূতির মা ও প্রত্যক্ষদর্শী সাজেদা বেগম। তিনি বলেন, নার্স-আয়ারা টেনেহিঁচড়ে বাচ্চা মেরে ফেলেছে। তিনি ঘাতকদের বিচার দাবি করেন। এ বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, অবহেলায় নবজাতকের মৃত্যুর কথা শুনেছি। তদন্ত করে দেখব। জড়িত বা দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে ধানমন্ডির ব্যবসায়ী জাকির হোসেন খান (৫১)। গত সোমবার বুকে ব্যথা নিয়ে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রাথমিক চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। এক দিন পর আবারও অসুস্থ হলে তাকে ওই হাসপাতালেই নেওয়া হয়। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শেখর কুমার মণ্ডলের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা শুরু হয়। জাকির হোসেনের পরিবারের দাবি, ওই রাতে চিকিৎসক তাদের জানান তার হার্টে ব্লক রয়েছে। দ্রুত রিং বসাতে হবে। পরিবারও তার কথা মতো রিং বসানোর সিদ্ধান্তে সম্মত হয়; কিন্তু রিং বসানোর পর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। গত বৃহস্পতিবার সকালে রোগী মারা যান। তার স্বজনদের দাবি, ভুল চিকিৎসায় মারা যান জাকির হোসেন। চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা এ ঘটনার বিচার প্রত্যাশা করলেও কোনো মামলা কিংবা আইনি ব্যবস্থা নেননি। এর আগেও ওই হাসপাতালে আলী আশরাফ নাজির নামে ১০ বছরের এক শিশুর খতনা (মুসলমানি) করার সময় অতিরিক্ত অ্যানেস্থেশিয়ার কারণে মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। শিশুর চাচা নবীন কালবেলাকে বলেন, ভাতিজাকে হারিয়ে পরিবারের সবাই ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বিচারের জন্য চেষ্টা করে দেখেছি; কিন্তু কিচ্ছু হয় না। তাই হাল ছেড়ে দিয়েছি।
সম্প্রতি ভুল চিকিৎসায় গালফ এয়ারের পাইলট ও মার্কিন নাগরিক ইউসুফ হাসান আল হিন্দির মৃত্যুর অভিযোগে ইউনাইটেড হাসপাতালের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে গত ১৪ মার্চ ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, গত ১ ডিসেম্বর রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় দৌলত বেপারি নামে এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ করেছিল তার পরিবার। এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় রোগীর স্বজনদের মারধরেরও অভিযোগ উঠেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। যদিও ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর বিষয়টি অস্বীকার করেছে কর্তৃপক্ষ।
অভিযাগ শুধু রাজধানীতে নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ বেড়েছে। গত ২৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের শহরতলির যশোদল এলাকায় আল-হেরা ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড হসপিটালে সন্তান জন্মদানকালে রূপালী বেগম নামে এক গৃহবধূ মারা যান। তার স্বজনদের অভিযোগ, ডা. আক্তার নাহার জ্যোতি রূপালীকে সিজারিয়ান করার জন্য অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর তার একটি পুত্রসন্তান জন্ম হয়। সন্তান জন্ম নেওয়ার দীর্ঘ সময় পার হলেও রূপালী বেগমকে রহস্যজনক কারণে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করা হচ্ছিল না। রাত ৯টার দিকে গৃহবধূ রূপালীকে ওটি থেকে অচেতন অবস্থায় বের করে স্বজনদের না জানিয়ে তড়িঘড়ি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মকর্তারা। তবে ময়মনসিংহ নেওয়ার পথে রাত ১০টার দিকে রূপালী বেগমের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পরপরই হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে যান কর্মকর্তারা।
রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একের পর এক ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে। এসব অভিযোগে কখনো কখনো রোগীর স্বজনরা হাসপাতালে হামলা-ভাঙচুর করছেন। আবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগীর স্বজনরাও। তবে ভুল চিকিৎসায় কী পরিমাণ মৃত্যু ঘটছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। এমনকি এর প্রতিকার কোথায়, তাও জানা নেই অনেক ভুক্তভোগীর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বৈশ্বিক মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার প্রধান ১০ কারণের অন্যতম অনিরাপদ চিকিৎসাসেবা। প্রতিবছর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ভুল চিকিৎসায় ১ কোটি ৩৪ লাখ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ২৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, চিকিৎসক ইচ্ছাকৃত রোগীকে মেরে ফেলেন না। অনেক সময় চিকিৎসার ভুলে রোগীর মৃত্যু হয়। এ ক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু কমাতে চিকিৎসকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে রোগী ও চিকিৎসকের নিরাপত্তা এবং অধিকার রক্ষায় একটি শক্তিশালী আইন করতে হবে।
ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু কমানোর ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, দক্ষ চিকিৎসকের একটা ঘাটতি আছে বলে আমরা মনে করি। চিকিৎসকদের আপডেট নিতে হবে। এজন্য একটা কম্পিটেন্সি টেস্ট চালু করা যেতে পারে। এটা অনেক দেশেই আছে। এ ছাড়া প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দক্ষতার একটা মান নির্ধারণ করে দিতে হবে। রোগীরা সন্তুষ্ট কি না, ওই প্রতিষ্ঠানের সেবায় সামগ্রিক মূল্যায়ন করে মান নির্ণয় করে দিতে হবে। সেইসঙ্গে রোগী ও চিকিৎসকদের অধিকার রক্ষায় একটি আইন প্রণয়ন ও তা কার্যকর করতে হবে।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ জানানোর সুযোগ রয়েছে; কিন্তু এই সুযোগ সাধারণ জনগণের পক্ষে কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। এমনকি অভিযোগ করেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিকার পাওয়া যায় না বলে ভুক্তযোগীদের অভিযোগ।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, জনবল কম থাকায় আমাদের প্রান্তিক মানুষেরও কষ্ট করে ভুল চিকিৎসার বিষয়ে অভিযোগ করতে হচ্ছে। এ ব্যবস্থাপনা দ্রুত প্রত্যেকের দোরগোড়ায় পৌঁছনো সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন বিষয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন পাস করে বাস্তবায়নের বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নির্লিপ্ত ও উদাসীন। এই আইন বাস্তবায়ন হলে রোগী ও চিকিৎসকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম বলেন, কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সেই বিষয়টি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল সমাধান করে থাকে। আর প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়। এ ছাড়া রোগী ও চিকিৎসকদের অধিকার বিষয়ে সরকার একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে।
রোগী, তার স্বজন, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকদের অধিকার রক্ষায় স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন-২০১৯ নামে একটি আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে রোগীদের অভিযোগ তদারকিতে হেলথ রেগুলেটরি কমিশন গঠন করতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জনগণের স্বাস্থ্য অধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং সংবিধানে উল্লিখিত স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করাই হবে এ কমিশনের কাজ। এ কমিশন গঠনে একটি খসড়া আইন তৈরি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর প্রাথমিক খসড়া আইনের কপিটি গত ৬ নভেম্বর হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে।
খসড়া আইনে কমিশনের কার্যাবলি ও তদন্ত-সম্পর্কিত তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, কমিশন যে কোনো স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে অবাধে ও বিনা বাধায় তদন্ত করতে পারবে। যে কোনো নির্দিষ্ট শাস্তি আরোপের সুপারিশ করতে পারবে। চিকিৎসার গাফিলতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা কর্তৃপক্ষকে অর্থদণ্ড প্রদান করতে পারবে এবং সেই অর্থ রোগীর কল্যাণে ব্যয় করার নির্দেশ দিতে পারবে। চিকিৎসার খরচের আংশিক বা সম্পূর্ণ অংশ ফেরত এবং কমিশন প্রদানের আদেশ দিতে পারবে। এভাবে মোট ১৯ দফা কার্যাবলি ও তদন্তের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে খসড়া আইনে। আইনে মোট ৩১টি ধারা যুক্ত করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে রিটকারী আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ড. বশির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, রোগীদের দুর্ভোগ শোনার জন্য কেউ নেই। সে কারণে হেলথ রেগুলেটরি কমিশন গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট করি। এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ কমিশন গঠনের একটি খসড়া আইন প্রণয়ন করেছে। হাইকোর্ট খসড়া আইনটির ওপর আমার লিখিত মতামত চেয়েছেন। আমি লিখিত মতামত দেব। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে খসড়া আইনটি দেখে আমার মনে হয়েছে, কমিশন গঠন হলেও সুপারিশ করা ছাড়া কমিশনের তেমন কোনো কার্যকর ক্ষমতা থাকবে না। আরও ত্রুটি-বিচ্যুতি যা আছে খসড়া আইনে, তা আদালতের কাছে তুলে ধরা হবে। আশা করছি, খুব শিগগির এ বিষয়ে শুনানি হবে।