কারসাজিতে কয়েক ব্যবসায়ী জড়িত

কারসাজিতে কয়েক ব্যবসায়ী জড়িত

দেশের অন্যতম বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এলসি ও আমদানি সংকটকে ইস্যু করে আদার দাম হুহু করে বাড়ছেই। চীন থেকে আদার আমদানি বন্ধ রয়েছে। মিয়ানমার ছাড়া এখন ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে তুলনামূলকভাবে কম আদা আমদানি হচ্ছে। ফলে ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র খাতুনগঞ্জের কিছু ব্যবসায়ীর হাতেই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আদার বাজারের। এসব ব্যবসায়ী বাজারে সংকট দেখিয়ে রাতারাতি পাইকারি বাজারে দাম বৃদ্ধি করায় খুচরা বাজারে প্রভাব পড়েছে। ফলে আদার দাম ঘিরে পাইকারি বাজারে যেমন প্রভাব পড়েছে, ঠিক তেমনি খুচরা বাজারে ক্রেতাদের মধ্যেও নানা প্রশ্ন ও শঙ্কা কাজ করছে। এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে জেলা প্রশাসন প্রতিনিয়ত মনিটরিং ও অভিযানে রয়েছে।

কাস্টম হাউস, খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজার ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার ছাড়া এখন ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে অনেক কম আদা আমদানি হচ্ছে। এ তিন দেশ থেকে মোট আমদানির ২০ শতাংশ আদা আসছে। চলতি মে মাসে ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি হওয়া আদার গড় মূল্য ৯৩ সেন্ট বা ৯৯ টাকা। শুল্ককরসহ খরচ পড়ছে ১০৯ টাকা। একই সময়ে ভিয়েতনামের আদার আমদানি মূল্য ৮৩ সেন্ট বা ৮৯ টাকা। শুল্ককরসহ দাম পড়ছে ৯৯ টাকা। এ দুই দেশের আদা পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা। আর খুচরায় ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। বাজারে বর্তমানে যে আদা বেচাকেনা হচ্ছে, তার ৮০ শতাংশই মিয়ানমারের। খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে ভারতীয় আদার সরবরাহ খুবই কম।

কাস্টমসের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে আদা আমদানি হয়েছে ৩২ হাজার ২৩৫ টন। চলতি মাসের ২২ দিনে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে ৩১ জন ব্যবসায়ী ১ হাজার ৮১৭ টন আদা আমদানি করেছেন। এসব আদার কেজিপ্রতি গড় আমদানি মূল্য ছিল ৪৫ সেন্ট বা ৪৮ টাকা। শুল্ককর দিতে হয়েছে কেজিপ্রতি প্রায় ১০ টাকা। এই হিসাবে কেজিপ্রতি আমদানি মূল্য পড়েছে ৫৮ টাকা। মিয়ানমার থেকে এক চালানে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ডলারের নিত্যপণ্য ও প্রায় ৩০ হাজার ডলারের বিবিধ পণ্য আমদানি করা যায়। এই সীমার মধ্যে পণ্য বেশি আমদানি করতে মূলত আমদানি মূল্য কম দেখানো হচ্ছে।

অন্যদিকে বাজারে আদা না থাকায় ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে দাম বাড়াচ্ছেন। বাজারে মজুক আদার দাম কিছু দিনের ব্যবধানে বেড়েছে কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ আড়তেই আদা নেই। কয়েকটি দোকানে কম পরিমাণে আদা দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাতুনগঞ্জে চীনা আদা নেই। মিয়ানমারের আদা বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা কেজিতে। ইন্দোনেশিয়ার আদা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা করে। খুচরায় প্রতি কেজি আদা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজিতে। ১৫ দিন আগে খাতুনগঞ্জে ভারতের কেরালা থেকে আসা আদা বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি কমবেশি ১১০ থেকে ১২০ টাকা করে, যা গতকাল বিক্রি হয় ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা করে।

খাতুনগঞ্জের মেসার্স শাহ মোহছেন আউলিয়া ট্রেডার্সের জয়নলা আবেদীন জসিম কালবেলাকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে আড়াতে কোনো ধরনের আদা নেই। আমদানিকারকরা আদা দিতে পারছেন না। চীনা আদা বাজারে নেই বললেই চলে।’

মেসার্স মোহাম্মদীয়া বাণিজ্যালয়ের ম্যানেজার মোহাম্মদ ফোরকান কালবেলাকে বলেন, খাতুনগঞ্জে চীনা আদা নেই বললেই চলে। মিয়ানমারের আদাও আছে কম। আমদানি কম হওয়ায় দাম বাড়ছে। তবে থাইল্যান্ডের আদা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়।

খাতুনগঞ্জের আদা, পেঁয়াজ ও রসুনের পাইকারি বাজারের হামিদুল্লাহ মিঞা মার্কেট কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস কালবেলাকে বলেন, মার্কেটে আদা চাহিদার চেয়ে অনেক কম আছে। আমদানি কমে যাওয়ার কারণে দাম বেড়েছে। আমদানি বাড়লে দাম কমে যাবে। আদা তো মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের খাবার। মিয়ানমারের আদা ২২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আর ইন্দোনেশিয়ার আদা ২৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আর ভিয়েতনাম ও চীনা আদা বাজারে নেই। আমদানিকারকরা কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমদানিকারকরা যখন লোকসান দেয়, তখন কেউ খবর নেয় না। ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিয়ে আদা আমদানি না করলে এটাও পেত না। ঈদ সামনে আরও আদা আমদানি হবে। তখন আদার দাম কমে যাবে।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ও সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খাতুনগঞ্জের বাজারে এখন আদার সংকট রয়েছে। বাইরের দেশের সরবরাহ বন্ধ এবং কিছু দেশ থেকে আদার চালান কম আসার কারণে বাজারে দাম বেড়ে গেছে। এখানে মূলত মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার আদা বেচাকেনা হচ্ছে। সংকটের অজুহাতে দাম বাড়লেও ঈদুল আজহা উপলক্ষে আদার নতুন চালান আমদানির পথে রয়েছে। সরবরাহ বাড়লে দামও স্থিতিশীল হবে। তবে প্রশাসনের কঠোর মনিটরিং এবং অভিযান অব্যাহত থাকলে দাম স্থিতিশীল অবস্থায় থাকবে। তা ছাড়া বাংলাদেশে আদা আমদানির বড় উৎস হলো চীন। করোনার সময় চীন থেকে আদা আমদানিতে যে ভাটা শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত আছে এখনো।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন কালবেলাকে বলেন, বিভিন্ন মৌসুমে ব্যবসায়ীরা বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে। নিজেদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রাখতে একটা চক্রও তৈরি করে। বাজারে নিজেদের গোডাউনে পণ্য মজুত থাকলেও পাইকারি বাজারে কৌশলে দাম বাড়িয়ে দেয়। ডলার ও আমদানি সংকটকে ইস্যু করেও তারা পণ্যের দাম বাড়ানোর চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে আমদানিকারক ও আড়তদারদের রহস্যজনক যোগসূত্র রয়েছে। ফলে প্রশাসনের মনিটরিং সেল কঠোর থাকলে তারা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে পারবে না।

২০১৯ সালে চীন থেকে সর্বশেষ আদা আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ৩৯ হাজার টন। ২০২০ সালে চীন থেকে আমদানি কমে যায়। এর পর দুই বছর ২০২০ ও ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি আদা আমদানি করা হয় ভারত থেকে। গত বছর মিয়ানমার থেকে বেশি আদা আমদানি করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, চীন থেকে সর্বশেষ আদা আমদানি হয় গত ১৭ এপ্রিল। ওই দিন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দুই কনটেইনারের দুটি চালানে ৫৪ টন আদা আমদানি হয়। প্রতি কেজি আদার আমদানি মূল্য পড়ে ১৭৮ টাকা। শুল্কসহ আমদানি মূল্য দাঁড়ায় ১৮৭ টাকা। এর পর গত এক মাসের বেশি সময় ধরে চীন থেকে একটি চালানও আমদানি হয়নি। বাজারে বর্তমানে চীনের আদা প্রতি কেজি ৪০০ টাকার ওপরে, যা মূলত ১৮৭ টাকায় আমদানি করা।

ট্যারিফ কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বছরে ৩ লাখ টন আদার চাহিদা রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন আদার উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৮২ হাজার টন। বাকি আদার চাহিদা মেটানো হয় আমদানি করে।

সম্প্রতি খাতুনগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করেছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) উমর ফারুক। তিনি বলেন, বাজারে পাইকারি এবং খুচরা ব্যবসায়ীর মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগী একটি সিন্ডিকেট আছে, যারা পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে অনেকাংশে দায়ী। আমরা বিভিন্ন ট্রেডিংয়ের দোকান থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের নাম এবং মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করেছি। যাদের মাধ্যমে একটি পণ্যের দাম হাত বদল হয়ে হয়ে দাম বাড়তে থাকে। সরবরাহ কমার অজুহাতে যাতে জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে না পরে, সেই বিষয়ে লক্ষ রাখা হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com