
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ দেশের মানুষকে দেয় উন্নয়ন, বিএনপি দেয় সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার অর্থই হচ্ছে মানুষের ওপর অত্যাচার করা, শোষণ ও বঞ্চনা করা। আর আওয়ামী লীগ মানুষকে উন্নয়ন উপহার দেয়। তিনি আরও বলেন, আজ আমরা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। ভূমিহীন থাকবে না। কিন্তু আমরা মানুষের জন্য কাজ করলেও বিএনপি মানুষের ভূমি দখল করে।
গতকাল শনিবার বিকেলে ময়মনসিংহের সার্কিট হাউস মাঠে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি এসব কথা বলেন। এর আগে বিকেল ৩টার দিকে প্রধানমন্ত্রী জনসভার পাশেই সুইচ টিপে ময়মনসিংহ বিভাগ এবং জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ১০৩টি উন্নয়নকাজের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর মধ্যে প্রায় ৫৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৭৩টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন এবং প্রায় ২ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০টি উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দুপুর ২টা ৫৮ মিনিটে মঞ্চে ওঠার সময় ময়দান ছাপিয়ে জনতা আশপাশের সড়কগুলোয় অবস্থান নেয়। মঞ্চে ওঠে সবাইকে হাত নাড়িয়ে শেখ হাসিনা যখন শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন, তখন স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় গোটা সার্কিট হাউস মাঠ। এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইকরামুল হক টিটু, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি মানুষের সম্পত্তি দখল করে। আর আওয়ামী লীগ যাদের ঘর নেই, বাড়ি নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, রাস্তার পাশে পড়ে থাকে, তাদের ঘরবাড়ি বানিয়ে দেয়। তাদের জীবন জীবিকার ব্যবস্থা করে দেয়। আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। ৩৫ লাখ মানুষকে ইতোমধ্যে আমরা ঘর করে দিয়েছি, আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে আরও ৪০ লাখ মানুষকে ঘর করে দেওয়া হবে।
১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের সময় ৪০ মিলিয়ন খাদ্য ঘাটতি ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাত্র দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২৬ লাখ টন খাদ্য আমরা মজুত রেখে যাই। ২০০১ সালে লুটেরার দল, সন্ত্রাসীর দল বিএনপি সেই বাংলাদেশকে আবার খাদ্য-ঘাটতি দেশে পরিণত করে। ২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করি, তখন ২৬ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। আল্লাহর রহমতে এখন আর খাদ্য ঘাটতি নেই। ২১ লাখ টন খাদ্য এখন আমাদের মজুত আছে। বৈশ্বিক অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ আর করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে জিনিসের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই আমাদের দেশের মানুষ যাতে কষ্ট না করে, সেজন্য ১ কোটি মানুষকে আমরা মাত্র ৩০ টাকা কেজিতে চাল কেনার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ৫০ লাখ নিম্নবিত্ত মানুষের ১৫ টাকা কেজিতে চাল কেনার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কোনো মানুষ যেন কষ্ট না পায়, সেজন্যই আমরা এতসব করে যাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এসে বিনা পয়সায় বই দিচ্ছে। আড়াই কোটি শিক্ষার্থীকে প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আমরা বৃত্তি-উপবৃত্তি এবং গবেষণার জন্য টাকা দিয়ে সহযোগিতা করছি। প্রতিটি এলাকায় স্কুল করে দিয়েছি। নতুন নতুন স্কুল ভবন করেছি। ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল সরকারীকরণ করেছি। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে দিয়েছি। এসব কারণেই আজকে আমাদের সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ২ ভাগে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি।
বিএনপি সরকার আমলের পরিসংখ্যান তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ৪১ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। ২০০৯ সালে আমরা সরকার গঠনের পর দারিদ্র্যের হার ২০ ভাগে নামিয়ে এনেছি। ৯৬ সালে প্রথমবার আমরা যখন সরকারে আসি, তখন সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৪৫ ভাগ। পাঁচ বছরে ৬৫.৫ ভাগে উন্নীত করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ২০০১-এ বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে লুটপাট, সন্ত্রাস, বাংলা ভাই, জঙ্গিবাদের রাষ্ট্র বানিয়ে তোলে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশেকে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট করে। সাক্ষরতার হার সেই ৬৫ ভাগ থেকে কমিয়ে আবারও আগের জায়গায় নিয়ে যায়। এর কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া, তিনি নাকি মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সেই পরীক্ষায় অঙ্ক আর উর্দুতে পাস করেছিলেন। কারণ, উর্দু পাকিস্তানের ভাষা, তাই উনারও প্রিয় ভাষা ছিল। আর অঙ্ক টাকা গোনায় লাগে, তাই ওই দুই বিষয়েই পাস করে বাকিগুলোতে ফেল করেন। জিয়াউর রহমান মেট্রিক পাস, খালেদা জিয়া মেট্রিক ফেল আর তাদের ছেলে তারেক রহমান বিভিন্ন স্কুল থেকে বহিষ্কার হয়ে কোথা থেকে যেন সার্টিফিকেট জোগাড় করেছে। কিন্তু সে কী পাস করেছে, তা কেউ বলতে পারে না। তবে বোমা মারা, গ্রেনেড হামলা, লুটপাট, মানি লন্ডারিং, টাকা চুরি, দুর্নীতি, এতিমের অর্থ আত্মসাতে তারা পারদর্শী। সেজন্য বাংলাদেশের মানুষ লেখাপড়া শিখবে ও উন্নত হবে, এটা তারা চায় না।
ময়মনসিংহের উন্নয়ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এই ময়মনসিংহকে বিভাগ ঘোষণা করে। যেহেতু প্রতিটি বিভাগে আমরা একটা করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছি, সেহেতু ময়মনসিংহেও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ও আমরা আলাদাভাবে করে দেব। বিভাগের উপযুক্ত প্রতিটি কাজই আমরা করব ময়মনসিংহের জন্য। তিনি আরও বলেন, যুবসমাজের কর্মসংস্থানের জন্য ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিচ্ছি। কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে যুবকদের বিনা জামানতে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা দিচ্ছি। এই ঋণ নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আরও ১০টি লোকের চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে যুবকদের। এভাবেই সবাইকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। যারা উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করবে, তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থাও আমরা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি শুনেছি, বিএনপির কোনো এক নেতা আছে নাকি সারাদিন মাইক নিয়ে বসে থাকে। তারা বলে, আমরা নাকি দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছি। ময়মনসিংহবাসী আপনারাই বলুন, এই যে আমরা ৭৩টি প্রকল্পের উদ্বোধন, ৩০টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেছি, এগুলো কি ধ্বংসের নমুনা! তাহলে ওরা এত মিথ্যা কথা বলে কেন? বিদ্যুৎ উৎপাদন আমরা বাড়াই, আর বিএনপি কমায়। এখন বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে, তাই আমরা উৎপাদনও বাড়িয়েছি। আমরা চাই, সব ঘর আলোকিত হোক। বিদ্যুৎ না হলে এত কথা মাইকে আসত কীভাবে।’
উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা আমাদের ধরে রাখতে হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। ২০৪১ সালে আমাদের জনগোষ্ঠী স্মার্ট হিসেবে গড়ে উঠবে। আমাদের গ্রাম, কৃষি সবকিছু হবে স্মার্ট। আমাদের লক্ষ্যই হচ্ছে দেশের উন্নয়ন করা। আজকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশকে আরও উন্নত করব, এজন্য ডেলটা প্ল্যান-২১০০ গ্রহণ করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বক্তব্যের শেষে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কাব্যিক ছন্দে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রিক্ত আমি, নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।’
জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এহতেশামুল আলমের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাক মোহিত উর রহমান শান্তর সঞ্চালনায় জনসভায় আরও বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপি, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মদ হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, মীর্জা আজম এমপিসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং সংসদ সদস্যরা।
প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে বিশেষ ট্রেনে লাখো মানুষ: জনসভায় যোগ দিতে বিভাগের জামালপুর-ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা—এই তিন জেলা থেকে বিশেষ আটটি ট্রেনে বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহে আসেন লাখো নেতাকর্মী। ট্রেনের ভেতরের আসন পরিপূর্ণ হওয়ায় নেতাকর্মীরা ওঠেন ছাদে। ইঞ্জিনের সামনেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়াতে দেখা গেছে অনেককে। এ যেন ঈদে ঘরমুখো মানুষের বাড়ি ফেরার প্রতিচ্ছবি। ঠাঁসাঠাঁসি করে আসা মানুষগুলোর হৃদয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সীমা ছিল না। প্রায় সাড়ে ৪ বছর পর ময়মনসিংহ নগরে প্রধানমন্ত্রীকে সামনে থেকে দেখতে ও তার কথা শুনতে ছুটে আসেন এসব মানুষ। ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন স্টেশন থেকে মিছিল নিয়ে তারা যান সমাবেশস্থলে।
মিছিলে মুখর ছিল নগরীর প্রতিটি সড়ক : প্রধানমন্ত্রীর জনসভা উপলক্ষে গতকাল সকাল থেকেই মানুষের ঢল নামে। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’—এমন স্লোগানে মুখর ছিল ময়মনসিংহ নগরীর প্রতিটি সড়ক। ট্রেন, বাস, ট্রাকে করে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নগরীতে আসে আওয়ামী লীগ এবং দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। সড়কের একপাশ দিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে হাজার হাজার কিশোর, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধসহ নানা বয়সী নারী-পুরুষ ছুটে যান মিছিল নিয়ে। বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লাখো জনতার সেই স্রোত গিয়ে মেশে ঐতিহাসিক সার্কিট হাউস মাঠে।