বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৩, ০৮:১৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বায়োফার্মার টাকা পাচার নিয়ে প্রতিবেদন চান হাইকোর্ট

বায়োফার্মার টাকা পাচার নিয়ে প্রতিবেদন চান হাইকোর্ট

বায়োফার্মা লিমিটেড নামের ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে দেশে দেশে টাকা পাচার ও কর ফাঁকির যে অভিযোগ উঠেছে, তা তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে এই প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। দৈনিক কালবেলায় ‘দেশে দেশে পাচার বায়োফার্মার টাকা’ শীর্ষ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে গতকাল রোববার বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

একই সঙ্গে রিট আবেদকারী ডা. মোর্শেদ উদ্দিন আকন্দ এবং ডা. জাহাঙ্গীর আলমকে বরখাস্তের বিষয়ে দেওয়া আবেদন নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এই দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং এই দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। চার সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আব্দুস সালাম মামুন এবং রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন মো. সাইফুদ্দিন খালেদ।

এর আগে গত ১৮ এপ্রিল ‘দেশে দেশে পাচার বায়োফার্মার টাকা’ শিরোনামে ওই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, দেশে মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তোলা হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও; কিন্তু লন্ডনে স্ত্রীর জন্য চেয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয়। শুধু তাই নয়, লন্ডনে কোম্পানি খুলে ব্যবসাও করছেন। কয়েকটি দেশে তৈরি করেছেন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য দেশ থেকে অবৈধ চ্যানেলে নেওয়া হয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা। বিদেশে টাকা পাচার করে বিত্তবৈভবে ফুলেফেঁপে উঠলেও যেই কোম্পানির হাত ধরে এত কিছু, সেই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে রুগণ দশায়। গত ১৫ বছরেও শেয়ারহোল্ডারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়নি বার্ষিক সাধারণ সভা। ২২ বছর ধরে দেওয়া হয় না কোনো লভ্যাংশ। এ সময়ে মোট পণ্য বিক্রির ৪০ শতাংশ কম দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এসব

অনিয়মের চিত্র। এমন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানটি হলো বায়োফার্মা লিমিটেড। ওষুধ শিল্পে একসময়ে নেতৃত্ব দেওয়া এ প্রতিষ্ঠানটি এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে। ধারাবাহিক অনিয়মে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের মূল কারিগর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ডা. লকিয়ত উল্লাহ। কাগজে-কলমে ডিএমডি হলেও তিনিই প্রতিষ্ঠানটির সর্বেসর্বা। ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বায়োফার্মা লিমিটেড’ নামের ওষুধ কোম্পানিটি। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে পাস করা কয়েকজন চিকিৎসক কিনে নেন প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিটি নতুনভাবে যাদের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়, তাদের বেশিরভাগই জামায়াতের নেতাকর্মী। পরে এটিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। সাধারণ শেয়ারহোল্ডার হিসেবে যাদের নেওয়া হয়, তাদের বেশিরভাগই উদ্যোক্তাদের ‘নিজের লোক’।

বায়োফার্মার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কোম্পানির বতর্মান ৯ পরিচালক ঘুরেফিরে আছেন পরিচালনা পরিষদে। সাবেক চেয়ারম্যান এন এ কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে বেশকিছু সরকারবিরোধী মামলা রয়েছে। তিনি ২০১৯ সালে পালিয়ে স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্র চলে যান। এর পরও রয়ে গেছেন উপদেষ্টা হিসেবে। বর্তমানে চেয়ারম্যান পদে আছেন শেয়ারহোল্ডার নাছিমা বেগম ঝুমুর প্রতিনিধি হিসেবে তার স্বামী ডা. শাহাবুদ্দিন আহমদ। ১৮ বছরের সাবেক এমডি ডা. আনোয়ারুল আজিম এখন ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। আর ডিএমডি ডা. লকিয়ত উল্লাহ শুরুতে ছিলেন নির্বাহী পরিচালক (মার্কেটিং)। তারা তিনজনই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে আছেন ডা. মো. মিজানুর রহমান। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন।

অন্য পরিচালকরা হলেন ডা. জহির উদ্দিন মাহমুদ, ডা. আলী আশরাফ খান, শেয়ারহোল্ডার নাজমা হকের প্রতিনিধি ও তার স্বামী ডা. ফজলুল হক মজুমদার এবং সাইফুল আমিন। তারা প্রত্যেকেই জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বে রয়েছেন। তাদের মধ্যে আলী আশরাফ নারায়ণগঞ্জ থেকে জামায়াতের হয়ে সংসদ নির্বাচনও করেছিলেন। জামায়াত সমর্থিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড বিজনেসম্যান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের (আইবিডব্লিউএফ) মহাসচিবের দায়িত্বে আছেন বায়োফার্মার ভাইস চেয়ারম্যান ডা. আনোয়ারুল আজিম। কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানির নেতৃত্বস্থানীয় প্রায় সবাই শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং বিভিন্ন পদে দায়িত্বও পালন করেছেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে নিজেদের আড়াল করা শুরু করে কোম্পানির নেতৃত্বস্থানীয়রা। বন্ধ করা হয় বার্ষিক সাধারণ সভা। গোপনে সম্পন্ন করা হতো কোম্পানি সংশ্লিষ্ট সব আইনি কর্মকাণ্ড। এমনকি জামায়াতের নেতাকর্মীদের মামলার খরচের টাকার জোগানও দেওয়া শুরু হয় কোম্পানি থেকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে গঠিত ফান্ডেও টাকা দেওয়া হয়। এসব টাকা দেওয়ার নথিও গোপনে বিভিন্ন খাত দেখিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয় কোম্পানির হিসাবে। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ তদন্তেই এমন চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং শেয়ারহোল্ডাররা জানান, বায়োফার্মা গঠনের পর থেকে লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়নি। বলা হতো, লাভের টাকাগুলো কোম্পানির উন্নয়নে খরচ করা হচ্ছে। এসবের নথি কখনো প্রকাশ করা হয়নি। ২০০৮ সালের পর থেকে সরকারের রোষানলে পড়ার ভয় দেখিয়ে প্রকাশ্যে বার্ষিক সাধারণ সভাও বন্ধ করা হয়। কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ ছিল নানা আইনি কাজ। শুরু হয় অন্যত্র টাকা পাচার। হঠাৎ করে ২০০৯ সালে কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে একে একে প্রায় ১২টি কাগুজে কোম্পানি করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান অনেকটা অস্তিত্বহীন। এগুলোর সঙ্গে অস্বাভাবিক লেনদেন চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। বিশেষ করে ‘বায়োফার্মা ফাউন্ডেশন’ ও ‘গোল্ড র ট্রেডিং কোম্পানি’সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে বায়োফার্মার হিসাব থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

জানা যায়, কয়েকজন শেয়ারহোল্ডারের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে কোম্পানির গ্রুপ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ব্যবসা উন্নয়ন সভা আহ্বান করা হয়। সেখানে উপস্থিত প্রতিনিধিদের দাবির মুখে সব অনিয়ম তদন্তে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলো ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ ৪০৫ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। পাঁচ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানির প্রায় ৫০০ কোটি টাকা অনিয়ম, আত্মসাৎ ও পাচার হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকা গেছে জামায়াতের বিভিন্ন মামলা মোকাবিলা ও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর কর্মকাণ্ডে।

ডা. লকিয়ত উল্লাহর জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী কানেকশনসহ নানা অনিয়ম নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন কোম্পানির অন্যতম শেয়ারহোল্ডার চট্টগ্রামের পূর্ব মাদারবাড়ীর বাসিন্দা মোহাম্মদ ফরিদউদ্দিন কাউসার খান। কোম্পানি গঠনের ২২ বছর ধরে লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়নি উল্লেখ করে তিনি লেখেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় ২০০৮ সাল থেকে কোম্পানির এজিএম করা হয়নি। আমাদের বলা হয়েছিল, তখন এজিএম করলে জামায়াত কানেকশনের অভিযোগে কোম্পানি হাতছাড়া হতে পারে। পরে দেখা যায়, পরিচালনা পরিষদ বিশেষ করে লকিয়ত নানা কারসাজি করে কোম্পানির বিপুল পরিমাণ টাকা অন্যত্র পাচার করে দেন। এর পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা, যা পরে অভ্যন্তরীণ তদন্তেও ধরা পড়ে। এই প্রদিবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্টে রিট করেন ডা. মোর্শেদ উদ্দিন আকন্দ এবং ডা. জাহাঙ্গীর আলম।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মুক্তিযোদ্ধার ছদ্মাবরণে জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের চর : পররাষ্ট্রমন্ত্রী 

ফেনীতে পৃথক স্থানে সড়কে ঝড়ল ২ প্রাণ

রাতেই ৯ জেলায় ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে কোলে নিয়ে কাবা দেখালেন নিরাপত্তা কর্মকর্তা

রেকর্ড গড়তে ১৩ সেকেন্ডে এক লিটার লেবুর শরবত পান

অনিয়মের অভিযোগে বন্ধ ৮২ লাখ টাকার সড়ক

এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের জন্য দুম্বা আনছে জলদস্যুরা!

পরিসংখ্যান ব্যুরোতে ৭১৪ জনের পুনর্বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, থাকছে না বয়সের ছাড় 

চট্টগ্রামে পোশাক কারখানায় আগুন

বিডিজেএ'র সভাপতি মাসুম, সম্পাদক মাহবুব সৈকত

১০

অন্তর্বাস না পরায় নারীকে বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়ার হুমকি

১১

ত্বক ঝকঝকে রাখবে তরমুজ

১২

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাজারে নেই কার্যত তদারকি

১৩

আঘাতের চিহ্ন পিঠে নিয়ে ভেসে এলো মৃত জোড়া কচ্ছপ

১৪

জাতীয় দিবসে হাসপাতালে আলোকসজ্জা না করায় শোকজ

১৫

১৫ হাজার টিকিটের জন্য ঘণ্টায় ২ কোটিবার চেষ্টা

১৬

চাচার ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ভাতিজা নিহত

১৭

১৫৯ জনবল নিয়োগ দেবে রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়

১৮

হোয়াইটওয়াশ বাঁচানোর মিশন টাইগারদের

১৯

অলীক স্বপ্ন 

২০
*/ ?>
X