শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৩, ০৭:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেল এখনো নিষ্ক্রিয়

যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেল এখনো নিষ্ক্রিয়

n

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক, সহপাঠী, সিনিয়র বড় ভাই ও ক্ষেত্রবিশেষে বখাটেদের দ্বারা নারী শিক্ষার্থীর যৌন হয়রানি দিন দিন বাড়ছে। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে গঠিত কমিটি অনেকাংশেই নিষ্ক্রিয়। এই কমিটি সম্পর্কে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিছু জানেনই না। ভুক্তভোগীরা জানেন না কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে। সে কারণেই এখনো ভুক্তভোগীরা ছুটে যান প্রক্টর অফিস কিংবা প্রতিকার কমিটির কাছে। এসব জায়গায় অভিযোগ জানিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয় ভুক্তভোগীদের। অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ক্ষমতাবান বা রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় চাপের মুখে অভিযোগ তুলে নিতে হয়।

জানা গেছে, ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট কর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনসহ দিকনির্দেশনামূলক রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ‘কমিটিতে কমপক্ষে পাঁচজন সদস্য থাকবেন। বেশিরভাগ সদস্য হতে হবে নারী এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে দুজন সদস্য নিতে হবে। সম্ভব হলে একজন নারীকে কমিটির প্রধান করতে হবে।’ নির্দেশনায় আরও বলা হয়, ‘সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি শিক্ষাবর্ষের পাঠদান কার্যক্রমের শুরুতে এবং প্রতি মাসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। সংবিধানে বর্ণিত লিঙ্গ সমতা ও যৌন নিপীড়ন সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা বই আকারে প্রকাশ করতে হবে।’

হাইকোর্টের রায়ের পর ইউজিসি একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়। এরপর এক যুগ অতিবাহিত হলেও রায়টি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এখন পর্যন্ত দেশের ৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৫টি ও ১০৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৭২টিতে যৌন নির্যাতনবিরোধী সেল গঠন করা হয়েছে। এদিকে কমিটি গঠিত হলেও অর্থবরাদ্দ না থাকায় বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ওরিয়েন্টেশন ও প্রচারের ব্যবস্থা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে কমিটির সভাপতি ও দায়িত্বশীলদের ফোন নম্বর দেওয়ার নির্দেশ থাকলেও বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় তা অনুসরণ করছে না। পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা করতে না পারা এবং সচেতনতার অভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বেড়েই চলছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অভিযোগ দিলেও সেগুলো খতিয়ে দেখতে লম্বা সময় পার করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমনও হয়েছে, আবেদন করে ছাত্রজীবন শেষ হলেও প্রতিকার পাননি। এ ছাড়া শিক্ষক, অভিযুক্তের বন্ধু ও রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন জায়গার চাপে অনেকে অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী পল্লব রানা পারভেজের বিরুদ্ধে নিজ বিভাগের তিনজনসহ পাঁচ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানি, ফেক আইডি খুলে সাইবার বুলিং, রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত করাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ তোলে। তারা প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দ্বারা পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চে অভিযোগ জানায়। পরে প্রক্টর অফিসেও অভিযোগ যায়।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানান, যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেল বলে কিছু আছে, সেটি তারা জানতেন না। সে কারণে প্রক্টর অফিস ও নিরাপত্তা মঞ্চের কাছে অভিযোগ দেন; কিন্তু বিভাগে না জানিয়ে অভিযোগ করায় তাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। বিভাগের মান-সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে দাবি করে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ তুলে ফেলার জন্য চাপ দেওয়া হয়। অভিযুক্তের পক্ষেও অনেকে হুমকি দিতে থাকে। বাধ্য হয়ে কয়েকজন অভিযোগ তুলে নেন। এ ঘটনায় অভিযুক্তের নিজ বিভাগ থেকে শাস্তির ব্যবস্থা করলেও অন্য দুটি বিভাগ আজ পর্যন্ত ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। প্রক্টর অফিস থেকেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান ওরফে নূরের বিরুদ্ধে দুজন নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। পারভেজের বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আছে জানিয়ে প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, অভিযোগকারীরা এ বিষয়ে দ্রুতই অবগত হয়ে যাবে। আর রাকিবের বিষয়টি আবার দেখতে হবে।

গত দুই বছরে ঢাবির শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক আক্তারুজ্জামান সিনবাদ ও তার সঙ্গে ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষার্থী পুলক বাড়ৈ ও ছাপচিত্র বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী শুভ্র বাড়ৈ, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আকরাম হোসেন, লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ও নারী সহকর্মীদের হেনস্তা ও যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে।

চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করা হলেও গত এক বছরে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। অন্য অভিযোগগুলোর বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ‘কোনো অভিযোগ আসেনি’ এবং ‘কিছুই জানি না’ বলে এড়িয়ে গেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘স্পর্শকতার বিষয়ে কিছুই বলব না’ বলে কল কেটে দেন ঢাবির যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেলের সভাপতি ও রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদা। সেলের সদস্য উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, যাচাই-বাছাই শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রক্টর অধ্যাপক ড. একে এম গোলাম রব্বানী বলেন, যৌন নির্যাতনের শিকার হলে একজন শিক্ষার্থী হল, বিভাগ, অনুষদ, প্রক্টর অফিস, যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ সেল এবং উপাচার্য; এসব জায়গায় অভিযোগ করতে পারেন; কিন্তু দেখা যায়, বেশিরভাগ অভিযোগই আসে প্রক্টর অফিসে। কারণ, অন্য মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ জানাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না সম্ভবত। আর অনেক মাধ্যম সক্রিয় না থাকাও অন্যতম কারণ হতে পারে। এসব মাধ্যম সক্রিয় হলে আমাদেরও কাজের চাপ কমত।

সম্প্রতি খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শহীদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএসকে ধর্ষণের অভিযোগে আদালতে মামলা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান, ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক বিটপ শোভন বাছাড় এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছোটন দেবনাথের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এদের মধ্যে উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো তদন্ত হয়নি। ছোটন দেবনাথকে সাময়িক অব্যাহতি দিলেও ক্যাম্পাসের বাইরের ঘটনা হওয়ায় যৌন হয়রানির অভিযোগটি বিবেচনা না করেই তার বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। আর বিটপ শোভন বাছাড়ের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্তই শেষ হয়নি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছরে চার শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের শিক্ষক বানানোর প্রলোভনে একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, ভুক্তভোগী ছাত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং জোর করে দায়মুক্তির পত্র আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নিয়ম অনুযায়ী বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগ কমিটির তদন্ত করার কথা থাকলেও এ বিষয়ে কিছুই জানেন না কেন্দ্রটির পরিচালক অধ্যাপক জেবুন্নেসা। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের সেলে এ অভিযোগ আসেনি। তদন্তাধীন বিষয় উল্লেখ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি জাবি উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম।

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সিএসই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আক্কাস আলী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবির এবং কৃষি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এইচএম আনিসুজ্জামানসহ চার শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ সেল তদন্তও করেছে। তবে বছরের পর বছর পার হলেও সেসব প্রতিবেদন তোলা হয়নি রিজেন্ট বোর্ডে।

যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের সাবেক প্রধান মানসুরা খানম বলেন, সেল তদন্তের কাজ শেষ করে রেজিস্ট্রার দপ্তরে জমা দেয়। এরপর কেন সেগুলো রিজেন্ট বোর্ডে ওঠে না সে বিষয়ে আমাদের কিছু জানার থাকে না। তবে শিগগির এসব রিজেন্ট বোর্ডে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য একিউএম মাহবুব।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৫ হাজার টাকায় স্ত্রীকে ‘মাদক কারবারির’ হাতে তুলে ‍দিলেন স্বামী

ব্যারিস্টার সুমনের খেলা দেখতে হাজারো মানুষের ভিড়

সাতক্ষীরায় এমপির গাড়িতে হামলা

জব্বারের বলী খেলা ২৫ এপ্রিল

মতিঝিল আইডিয়ালের গভর্নিং বডির নির্বাচন অনুষ্ঠিত

খরুচে বোলিং মোস্তাফিজের, চেন্নাইয়ের হার

এফডিসিতে ৫৭০ ভোটারের সংবাদ সংগ্রহে ৩০০ সাংবাদিক

যশোরে অধিকাংশ টিউবওয়েলে মিলছে না পানি

বিদেশি শ্রমিকদের সুখবর দিল কুয়েত

এফডিসিতে ফিরেছেন নির্বাচন কমিশনার, খোঁজ নেই নিপুনের

১০

চাঁদপুরে পূবালী ব্যাংক কর্মকর্তা নিখোঁজের ঘটনায় ৮ কর্মকর্তা বদলি

১১

বিআরটিএর অভিযানে ৪০৫ মামলা, ১০ লাখ টাকা জরিমানা 

১২

প্রেমিককে কুপিয়ে জখম, প্রেমিকা আটক

১৩

আরও ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি

১৪

‘গোপালগঞ্জের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ অচিরেই চালু হবে’ 

১৫

‘আমাদের নিজেদের এবং দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যেতে হবে’

১৬

শ্যালকের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন পলক 

১৭

উৎকলিত রহমানের কবিতা ‘জ্যোতিষ্ময়ীর গান’

১৮

পাবনায় যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

১৯

পহেলা বৈশাখে প্রেমিকের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার তরুণী

২০
*/ ?>
X