সিলিকন ভ্যালির পর বন্ধ যুক্তরাষ্ট্রের সিগনেচার ব্যাংক

সিলিকন ভ্যালির পর বন্ধ যুক্তরাষ্ট্রের সিগনেচার ব্যাংক

সিলিকন ভ্যালির পর এবার যুক্তরাষ্ট্রের সিগনেচার ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তিন দিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল দুটি ব্যাংক। আর তৃতীয় বড় পতন দেখা গেল দেশটির ব্যাংকিং ইতিহাসে। এতে বিপাকে পড়েছেন দুই ব্যাংকের আমানতকারীরা।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত রোববার নিউইয়র্কের ব্যাংকটি বন্ধ ঘোষণা করে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি)। নিউইয়র্কের ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের তথ্যানুযায়ী, গত বছর শেষে সিগনেচার ব্যাংকের ছিল ১১০ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ। আমানত ছিল ৮৮ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।

ইউএস ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও অনান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে, সিগনেচার ও সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের (এসভিবি) আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের ব্যবস্থা করা হবে। আর করদাতাদেরও কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে না।

রয়টার্সের প্রতিবেদকরা জানিয়েছেন, সিগনেচার ব্যাংকের সদর দপ্তর ম্যানহাটনে। সেখানে গত রোববার বৈঠকের জন্য জড়ো হন কোম্পানির কর্মকর্তারা। সেই সময় অনেকে ইতালীয় রেস্তোরাঁ কারমাইনে খাবার এবং স্টারবাকসের কফির অর্ডার দেন। পরে ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা হলে সদর দপ্তর থেকে বেরিয়ে আসেন তারা।

গত শুক্রবার সিলিকন ভ্যালির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে তা নিয়ন্ত্রণে নেয় এফডিআইসি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে দ্বিতীয় বড় পতন। এর আগে ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালে গত বন্ধ হয়ে যায় ওয়াশিংটন মিউচুয়াল ব্যাংক। ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত সিলিকন ভ্যালির সম্পদ ছিল প্রায় ২০৯ বিলিয়ন ডলারের। ছিল ১৭৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের আমানত।

রয়টার্স এক বিশ্লেষণে সিলিবন ভ্যালি বন্ধের ঘটনাকে ছয়টি পর্যায়ে ভাগ করেছে। বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে প্রথমেই বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) ক্রমবর্ধমান নীতি সুদহারের কথা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত বছর থেকেই ধাপে ধাপে সুদহার বাড়াতে শুরু করে ফেড। সুদহার বৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে ঝুঁকি নিতে চান না। প্রযুক্তি খাতের বিনিয়োগকারীরাও ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। আর সিলিকন ভ্যালির প্রাথমিক গ্রাহকরা সব প্রযুক্তি খাতসংশ্লিষ্ট হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে সরাসরি ব্যাংকটির ওপর। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় প্রাথমিক ধাক্কায় কিছু স্টার্টআপ বন্ধ হয়ে যায়। এতে কিছু গ্রাহক নগদ অর্থসংকটে পড়েন। বেসরকারি পর্যায়ের তহবিল সংগ্রহও বেশ মূল্যবান হয়ে ওঠে। কিছু গ্রাহক তারল্য সংকট মেটাতে ব্যাংক থেকে নিজেদের অর্থ তুলে নিতে শুরু করেন। গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে গত বুধবার ব্যাংকটি লোকসানেই ২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বন্ড পোর্টফোলিও বিক্রি শুরু করে। ব্যালান্স শিট শক্তিশালী করতে বুধবার এসভিবি ২২৫ কোটি ডলারের শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণায় ব্যাংকের গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। পরদিন ব্যাংকটির শেয়ারের দর ৬০ শতাংশ কমে যায়। এতেই কাল হয়ে দাঁড়ায় ব্যাংকের পরিস্থিতি। বৃহস্পতিবার দিনভর আমানতকারীরা আমানত তুলে নেওয়ায় ব্যাপক আকারে মূলধন সংকট দেখা দেয়। সংকটময় পরিস্থিতিতে ৪৮ ঘণ্টাও টিকতে না পেরে ব্যাংকটি বন্ধ ঘোষণার মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। তবে আশার আলো দেখছেন সিলিকন ভ্যালির যুক্তরাজ্য শাখার গ্রাহকরা। ব্যাংকটি যুক্তরাজ্য শাখা এক পাউন্ডের বিনিময়ে কিনে নিয়েছে ‘এইচএসবিসি’। এ প্রতীকী দামে ব্যাংকটির ব্রিটেনের কার্যক্রম কিনে নেওয়ার উদ্দেশ্য দেশটির স্টার্টআপগুলোর গুরুত্বপূর্ণ এক ঋণদানকারীকে সংকট থেকে বাঁচানো। গতকাল রয়টার্স এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। এর আগে ব্যাংকটি কিনে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন টুইটার প্রধান ইলন মাস্ক।

আর সিলিকন ভ্যালিসংক্রান্ত সৃষ্ট আতঙ্কের জেরে বন্ধ হয়ে গেছে সিগনেচার ব্যাংক। গত সপ্তাহে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের গ্রাহকদের অর্থ তুলে নেওয়ার হিড়িক শুরু হলে সিগনেচার গ্রাহকরাও আমানতের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। এফডিআইসি সর্বোচ্চ আড়াই লাখ ডলার আমানতের সুরক্ষা দেয়। তাই আড়াই লাখের বেশি ডলার আমানতকারীদের আতঙ্কই বেশি বাড়ে। এফডিআইসি বলছে, ব্যাংক দুটি বন্ধ করা না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ত। শুক্রবার সিলিকন ভ্যালি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই সিগনেচার গ্রাহকরা আমানত তুলে নিতে শুরু করেন। সেই ঘটনায় সিগনেচারসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকের শেয়ারের দরপতন হয়। রোববার সকালে অর্থ তুলে নেওয়ার গতি কমে এলেও একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যাংকটি বন্ধ ঘোষণা করে। দেশজুড়ে তাদের ৪০টি শাখা ছিল।

তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্যে দেখা গেছে, গত বছরের শেষ দিকে সিগনেচার ব্যাংকের ১০ ভাগের প্রায় ৯ ভাগ আমানতের বিমা ছিল না। তারা সম্প্রতি ক্রিপ্টোকারেন্সির গ্রাহকদের টানতে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছিল। সিগনেচার ব্যাংকের গ্রাহক ছিলেন মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার ফ্লোরিডা গলফ কোর্সে ঋণ দেওয়াসহ ট্রাম্পের জামাই জ্যারেশ কুশনার ও তার পিতা চার্লস এ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে মূলত মধ্যম মানের ব্যাংকগুলো সংকটে পড়েছে। সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার, এ দুটো ব্যাংকই মধ্যম মানের। এগুলোর গ্রাহকভিত্তি জেপি মরগান, গোল্ডম্যান স্যাকসসহ বড় ব্যাংকগুলোর মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। এ কারণেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com