
গত ১০ বছরে দেশের অর্থনীতির মতো সম্পদ কর বাড়েনি। ফলে বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ কর হারাচ্ছে সরকার। একই সঙ্গে আয় বৈষম্যের চেয়ে সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। আয় বৈষম্য ১ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে থাকলে সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে ৩ শতাংশের বেশি। সিপিডির এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘স্টেট অ্যান্ড স্কোপ অব প্রোপার্টি ট্যাক্সেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সেমিনারে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, সম্পদের বৈষম্য ক্রমান্বয়ে ঘনীভূত হচ্ছে ও বৈষম্য কয়েকগুণ হারে বাড়ছে। দেশের ভেতরে সম্পদ যেভাবে ক্রমান্বয়ে ঘনীভূত হচ্ছে, তাতে ন্যায্যতা ও বৈষম্য কমাতে সম্পদ করের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এ ছাড়া বাজেট ঘাটতি কমাতে কর-জিডিপির অনুপাত আরও বাড়ানোর তাগিদ দেন তরা।
গবেষণায় বলা হয়, গত এক দশক ধরে কর-জিডিপির অনুপাত ৭-৮ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। বাজেট ঘাটতি কমাতে এই অনুপাত আরও বাড়ানো প্রয়োজন। জমি পতিত না রেখে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ
করে সেমিনারে বক্তারা বলেন, যদি উৎপাদন কাজে ব্যবহার না হয়, তবে এই ধরনের জমিতে প্রযোজ্য করের হার বাড়ানো উচিত। কর ফাঁকি, করের আওতা বৃদ্ধি করতে না পারা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতার কারণে রাজস্ব আদায় বাড়ছে না।
সিপিডির গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের রাজস্ব আয়ের ৫৫ শতাংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে। গত ৫ বছর প্রত্যক্ষ কর ৩৩ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। সম্পদ থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এটিকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। তাই প্রত্যক্ষ কর আদায়ের জন্য নতুন নতুন খাত সন্ধান করতে হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তার প্রবন্ধে বলেন, দেশের জিডিপি যদি ১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তাহলে সম্পদ কর ০.৪ শতাংশ বাড়ার কথা। যদি জিডিপি ৬ শতাংশ ও মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশ হিসাবে যোগ করে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি বিবেচনা করা হয়, তাহলে সম্পদ কর ৬ হাজার কোটি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। সেটা পাওয়া যায়নি। উন্নয়নশীল দেশ বিবেচনায় আফ্রিকার সম্পদ কর ০.৩ শতাংশ, বাংলাদেশ সেখান থেকেও পিছিয়ে আছে। অথচ বাংলাদেশের আয় আফ্রিকার দেশগুলোর চেয়ে বেশি।
দেবপ্রিয় বলেন, নতুন এলাকা হিসেবে ভূমি কর আধুনিক করতে হবে। হোল্ডিং ট্যাক্সকে যুগোপযোগী করতে হবে। সম্পদ আয় করে একটি প্রজন্ম। এটা ভোগ করে পরবর্তী প্রজন্ম। সেখানে ন্যায্যতা নিয়ে আসতে হবে। দেশের উত্তরাধিকার কর প্রচলন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে সার্বিক সুশাসন, কর ব্যবস্থাপনাকে সহজীকরণ এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা জরুরি।
সিপিডির এই ফেলো বলেন, দেশ পাঁচ ধরনের ট্যাক্স চলমান রয়েছে— ভূমি উন্নয়ন কর, ওয়েলথ সারচার্জ, হোল্ডিং ট্যাক্স, ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স ও গিফট ট্যাক্স। এর মধ্যে স্থাবর সম্পত্তি যখন নিজেদের মধ্যে দান বা হেবা হয়, সেখানে কোনো ট্যাক্স নেই। এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। শুধু উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই ট্যাক্স অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে।
দেবপ্রিয় বলেন, সরকার যখন অর্থনৈতিক অঞ্চল কিংবা বড় কোনো প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করে। তখন তারা ট্যাক্স দেয় না। সরকার তার নিজের প্রকল্পে ছাড় দিলে ব্যক্তি খাতের সঙ্গে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়। আবার সম্পদ সারচার্জ ৩৫ শতাংশ রয়েছে। এটাও উচ্চ। ট্যাক্স সিস্টেমের ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের মধ্যেও বৈষম্য রয়েছে। দেশের ভেতরে সম্পদ যেভাবে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যেভাবে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। ন্যায্যতা ও বৈষম্য কমাতে সম্পদ করের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ সম্পদ করের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। জমি ও বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে কর আরোপ হচ্ছে না। এখানে বৈষম্য রয়েছে। জমির ওপর বিনিয়োগ বাড়ছে, কারণ জমির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এটির বড় কারণ এই বিনিয়োগে বড় ধরনের কর দিতে হয় না।