শফিকুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:২৯ এএম
আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সম্পর্কোন্নয়নে সমান আগ্রহী বিএনপি ও ভারত

হাইকমিশনারের বৈঠক টার্নিং পয়েন্ট
সম্পর্কোন্নয়নে সমান আগ্রহী বিএনপি ও ভারত

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে রাজনীতিতে নানারকম প্রচার রয়েছে। দেশটির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝিও আছে। তবে ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের সেই টানাপোড়েন নিরসন হতে চলেছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় এ বিষয়ে নতুনভাবে চিন্তা করছে ভারত। একই সঙ্গে বিএনপিও ইতিবাচক। অন্যান্য দেশের মতো ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়নে সমানভাবে আগ্রহী দলটি। গত রোববার বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এরপরই বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক জোরদারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বৈঠক করেছেন। বৈঠকে ঢাকা ও দিল্লির পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

রাজনীতিকরা বলছেন, প্রণয় ভার্মার সঙ্গে হওয়া ওই বৈঠক উভয় দেশকে অনেক ইতিবাচক দিকে নিয়ে গেছে; যা সম্পর্কের টার্নিং পয়েন্ট। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিদেশি একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে তাদের যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল সেই বরফ গলতে শুরু করেছে। এই সম্পর্ক আরও ভালো হবে। কূটনৈতিক অঙ্গনে কাজ করেন বিএনপির এমন কয়েকজন নেতা কালবেলাকে বলেন, গত দেড় যুগের বেশি সময় ধরে ভারত তাদের সম্পর্ক শুধু একটি দলের সঙ্গে জোরদার করেছে। পক্ষান্তরে তাদের উচিত ছিল কোনো ব্যক্তি বা দল নয়, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করা। তবে বিএনপির হাইকমান্ডের প্রত্যাশা ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর এখন ভারত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে এবং সেটি হবে তাদের জন্যই ভালো।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বাংলাদেশে গত নির্বাচনের পর থেকেই আমাদের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এবার আমাদের অফিসে হাইকমিশনার (ভারতের) আসায় অবশ্যই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বরফ গলতে শুরু করেছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সবসময়ই খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে এবং সম্পর্ক উন্নত হয়েছে। অবশ্যই এটি টার্নিং পয়েন্ট। তিনি বলেন, আমরা দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা পানি ভাগাভাগি সমস্যা, সীমান্ত হত্যা, বিদ্যমান বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার কথা উল্লেখ করেছি। একই সময়ে, ভারতের প্রধান ইস্যু ছিল নিরাপত্তা সমস্যা। আমরা আশ্বস্ত করেছি, আমরা ক্ষমতায় থাকলে, আমরা নিশ্চিত করব—এ ভূখণ্ডটি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ব্যবহার করবে না।

এদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠককে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ওই বৈঠক অবশ্যই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা বিশ্বাস করি, এই বৈঠকের পর সম্পর্ক আরও মজবুত হবে। ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সহযোগিতা আরও শক্তিশালী হওয়া উচিত। জনগণের মধ্যে সম্পর্কই ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার মূল চাবিকাঠি।

২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়লে দুই বছর একটি সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার গঠন করে। এরপর ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক এগোতে থাকে এবং বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি হয়, যা বিভিন্ন সময় প্রমাণও মিলেছে। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি একতরফা এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন করে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তার মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ অন্যরা বর্জন করে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জনকে এমপি ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতা নেয় আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের ব্যানারে অংশ নিলেও আগের দিন রাতেই ব্যালট বাক্স ছিনতাই এবং ভোট ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এরপর দেশের বিরোধী দল ছাড়াই ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারিও একতরফাভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ।

বিএনপিসহ বিরোধী নেতাদের অভিযোগ—প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই ভারতের প্রচ্ছন্ন ইন্ধন ও প্রভাব ছিল। যে কারণে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় প্রথম সমাবেশ করে। সেদিন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এই সরকার (আওয়ামী লীগ) ভারত, চীন আর রাশিয়ার সরকার। সেজন্য এই সরকার আমরা মানতে বাধ্য নই। এই দেশ আমাদের, দেশের সমস্যাও আমাদের। এই দেশের সমস্যা সমাধান আমরাই করব। তারা যত যা-ই করুক, তাদের পতন অনিবার্য।

জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার কালবেলাকে বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতির কোনো কারণ নেই। প্রতিবেশী সবার সঙ্গেই তো আমাদের ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ভারত তার বাইরে নয়। তবে বিগত কয়েক বছরে ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারেনি। তারা বিশেষ দল এবং ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কে গুরুত্ব দিয়েছে। এখন নিশ্চয়ই তারা তাদের সেই ভুল বুঝতে পারবে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। আমরা শুধু ভারত নয়, সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। পরস্পরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ এবং মিউচুয়াল বেনিফিট থাকতে হবে। এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ না করা। এগুলোই তো সম্পর্কের ভিত্তি।

টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে আন্দোলনও অব্যাহত রাখে বিএনপি। মূলত ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর বিএনপিকে এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে ভারত। নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার পেছনের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে—১০ ট্রাক অস্ত্রের চালানের পেছনে বিএনপি সরকারের হাত ছিল। এটা নিয়ে ভারত সন্দেহ করে। এ ছাড়া অনুপ চেটিয়া বিএনপির বিরুদ্ধে বলায়। বিএনপি মনে করে, এসব কিছুই তাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার। অথচ বিএনপির হাইকমান্ড সবসময় মনে করেন, বিএনপির সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক ইতিবাচক ধারায় থাকলে আমাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা সুসংহতসহ এ অঞ্চলে কোনো অপশক্তিই কিছু করতে পারবে না।

এদিকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে গত সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তারা বাংলাদেশ ও ভারতের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে একমত হয়েছেন।

ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক অধ্যাপক ড. শাকিরুল ইসলাম খান শাকিল গতকাল বৃহস্পতিবার কালবেলাকে বলেন, গত প্রায় দেড় দশকে বিশেষ করে ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশে জনগণের কোনো সরকার ছিল না। দীর্ঘ এই সময়ে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিই জনগণের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিধ্বনি করে আসছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটা অনির্বাচিত সরকার (আওয়ামী লীগ) বিদায় নিয়েছে। সুতরাং সংগত কারণেই এখন ভারতসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যারা বিশ্বে গণতান্ত্রিক রোল মডেল হিসেবেও বিবেচিত। এখন হয়তো তাদের উপলব্ধি হয়েছে যে, বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে না, অবশ্যই জনগণের প্রতিনিধিত্ব যারা করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বা সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। যার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে সে দেশের জনগণ আসলে কি চায় সেই বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। যেটি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর স্বীকারও করেছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভুল কীটনাশকে কৃষকের ৫ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি

নেতানিয়াহু জাতিসংঘের মঞ্চে উঠতেই হট্টগোল, ওয়াকআউট

শেরপুরে ৩ শতাধিক শিক্ষার্থীকে পুরস্কৃত করল ছাত্রশিবির

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান ইউনূসের

অস্তিত্বহীন লিফট অপারেটরের বেতন নিয়ে বিপাকে প্রভাষক

ভারি বর্ষণে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪ গেট খোলা

কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত কেবিন

প্রত্যেক ফিলিস্তিনির জীবন অমূল্য : জাতিসংঘে ড. ইউনূস

জলবায়ু পরিবর্তন সবার জন্য হুমকি : ড. ইউনূস 

জাতিসংঘে নেতানিয়াহু / বিশ্বকে এখনই বেছে নিতে হবে শান্তি নয়তো অভিশাপ

১০

দুর্গাপূজায় মন্দির পাহারা দেবে বিএনপি : আজাদ

১১

জাতিসংঘে ড. ইউনূস / বুলেটের সামনে বুক পেতেছিল বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা

১২

শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আরও বেশি সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেন ড. ইউনূস

১৩

কয়রায় শহীদ জিয়া পরিষদের সভাপতি শাহারুল, সম্পাদক বাপ্পি 

১৪

গুম নিয়ে সরকারের কার্যক্রম জাতিসংঘে তুলে ধরলেন প্রধান উপদেষ্টা

১৫

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা

১৬

আওয়ামী সিন্ডিকেটে আটকা বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ

১৭

বিশ্ব পর্যটন দিবসে এসএবিপির আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

১৮

গাজায় অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান ড. ইউনূসের

১৯

আমলাদের একটা অংশ আ.লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে : আবু হানিফ

২০
X