
বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি কুশীলবদের ষড়যন্ত্র নতুন নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার বিরোধিতা থেকে শুরু করে পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, ওয়ান-ইলেভেনসহ নানা সময়ে বিভিন্ন অপতৎপরতা ছিল। এসব ষড়যন্ত্রে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনাও রয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেও দেশি-বিদেশি চক্রান্ত চলছে বলে সরকারের বিভিন্ন মহল ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। সরকারকে চাপে রাখতে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এলিট ফোর্স র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব অপতৎপরতা ঠেকাতে সোচ্চার হয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তব্য ও সাক্ষাৎকারে সরকারপ্রধান কড়া সমালোচনা করছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের অভিমত, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ উতরে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-রাজনীতি, ভূ-অর্থনীতি ও কৌশলগত নানা কারণ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তায়ও বাংলাদেশ প্রশংসিত ভূমিকা রাখছে। তাই বাংলাদেশকে নিজেদের বলয়ে রাখতে মরিয়া বিশ্বের দুই পরাশক্তি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে গত দেড় দশকে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক দৃঢ় সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে শেখ হাসিনার সরকার। এখন বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের সবচেয়ে বড় উৎস চীন, আর যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম রপ্তানি গন্তব্য হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে দেড় দশক ধরে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক সুরক্ষিত রয়েছে। এমনকি বহুল আলোচিত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের অবস্থানও স্পষ্ট করেছে। এমন বাস্তবতায় র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা গত দেড় বছরেও তুলে নেয়নি বাইডেন প্রশাসন। এটিকে বাংলাদেশের জাতিসত্তা ও আত্মসম্মানের ওপর আঘাত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা মনে করেন, বিশ্বজুড়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসিত হচ্ছে। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করা বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছে। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচন নিয়ে মার্কিন উদ্বেগ আমলে নিয়ে সরকার আশ্বস্তও করেছে। তা সত্ত্বেও আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকারকে চাপে রাখতেই দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে বিলম্ব করছে। এতে ইন্ধন দিচ্ছে টানা তিনবার সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মাঠের আন্দোলনে ব্যর্থ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। নির্বাচন সামনে রেখে নতুন করে ব্ল্যাকমেইল ও ষড়যন্ত্র রুখতেই সরকারপ্রধান মার্কিন সমালোচনায় সরব হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র রয়েছে। এই চক্রান্তকারীদেরই প্রধানমন্ত্রী বার্তা দিচ্ছেন, কোনো ষড়যন্ত্রের কাছেই বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণ মাথা নত করবে না। প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো বক্তব্য দেন, তা জনগণের মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হয়। এর ফলে সব ধরনের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়।
শেখ হাসিনার সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য টানাপোড়েন শুরু হয় ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাব ও এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে। সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেন। সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়, র্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তা আমলে নিয়ে বিচারের আওতায় আনা হয়। এ ছাড়া বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নানা তৎপরতায়ও অসন্তুষ্ট সরকার। একই সঙ্গে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতেও পুরোনো টানাপোড়েন নতুন করে চাড়া দেয়। তবে প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে মার্কিন সমালোচনা করেন ২০২২ সালের নভেম্বরে সরকারপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ বা স্বাচিপের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনে।
মানবাধিকারের কথা বললেও বঙ্গবন্ধুর সাজাপ্রাপ্ত খুনিকে আশ্রয় দিয়ে রাখা এবং র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতি হিসেবে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান সেদিন বলেছিলেন, ‘আমেরিকায় এক খুনি রয়ে গেছে। তাকে বারবার আনার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেহেতু তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে, আমেরিকা সেই খুনিকে লালন-পালন করছে। অবশ্য আমেরিকার কারবারই এ রকম। ড্রাগ ডিলারদের ধরতে গিয়ে আমাদেরই একজন এয়ারফোর্সের অফিসারকে ড্রাগ ডিলাররা অপহরণ করে নিয়ে যায়, অত্যন্ত নির্মমভাবে তাকে মারে, হত্যা করে। এ ব্যাপারে তাদের কিন্তু উদ্বেগ নেই।
সরকারপ্রধানের মার্কিন সমালোচনা আরও কঠোর হয় চলতি বছর। গত ১০ এপ্রিল জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আনা ১৪৭ বিধির সাধারণ প্রস্তাব ও অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে আমেরিকা চাইলে যে কোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে—এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, আবার দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই তারা ওকালতি করে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এখানে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে, যার গণতান্ত্রিক কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
গত ১২ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সারা দেশের জেলা শাখার নেতাকর্মীরা গণভবনে দেখা করতে এলে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাদের আগামী নির্বাচনের আগে দলকে আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি যে কোনো ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে। অনেকেই এমন গতিতে একটি দেশের অগ্রগতি চায় না। তাই তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে।’
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাজ্য সফরের সময় বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও মার্কিন সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, যে বাহিনীর ওপর তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটা তাদের পরামর্শেই ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাদের সব প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল। যেভাবে তারা বাহিনীটাকে তৈরি করেছে, তারা তো সেভাবেই কাজ করছে বলে আমার বিশ্বাস। তাহলে কেন তারা এই নিষেধাজ্ঞা দিল? এটা আমার কাছেও বিরাট এক প্রশ্ন।
এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না—এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হয়তো তারা আমার কাজ অব্যাহত থাকুক তা চায় না, আমি বাংলাদেশের জন্য যেসব উন্নতি করেছি, সেটা তারা হয়তো গ্রহণ করতে পারছে না। এটা আমার অনুভূতি। একটা পর্যায়ে সন্ত্রাস সব দেশের জন্য সমস্যা হয়ে উঠেছিল। আমাদের দেশে আমরা সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করেছি। এরপর মাত্র একটা ঘটনা ঘটেছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রাখতে কঠোর পরিশ্রম করেছে।’ অবশ্য এর আগেও প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেশের তেল-গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় ওই নির্বাচনে তার দলকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
স্বয়ং সরকারপ্রধানের মার্কিন সমালোচনায় ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের অস্বস্তি নিয়ে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক আলোচনা ও কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেওয়া ও নির্বাচনী চাপের কারণেই কি আমেরিকার ওপর অসন্তুষ্ট প্রধানমন্ত্রী? না নতুন করে কোনো ষড়যন্ত্রের তথ্য পেয়ে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন তিনি?
এ প্রসঙ্গে সাবেক কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের অন্যতম বাংলাদেশ নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার দেশি-বিদেশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগবান্ধব স্থিতিশীল পরিবেশ ধরে রেখেছে। এ দেশে নিজেদের মতো গণতন্ত্র, সংসদসহ সবকিছুই আছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক হানাহানিও নেই। এমন অবস্থায়ও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এবং পরে তা তুলে না নিয়ে বিশ্বকে বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী বার্তা দিতে চায়? এ প্রশ্নের মধ্যেই সরকারপ্রধানের বক্তব্যের কারণ লুকিয়ে আছে। তিনি এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ ও জনগণের পক্ষ থেকে কথা বলছেন। এ পর্যন্ত এ দেশে যত ষড়যন্ত্র, হত্যার রাজনীতি হয়েছে, তা নিয়ে কেউ কোনোদিন কথা বলেনি। প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়ভাবে কথা বলছেন। তিনি জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের মতো স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধির পথে ধাবমান দেশের একটি বাহিনীর প্রতি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেনি। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে, তারা আমাদের এক নম্বর রপ্তানির গন্তব্য। এরপর ইউরোপ, জাপান, ভারত ও চীন। উন্নয়ন সহযোগী ও বন্ধুদেশ হিসেবে নিষেধাজ্ঞার মতো চাপ না দিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার টেবিলে তারা উদ্বেগের ইস্যুতে কথা বলতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশ ১০ বছর আগের সেই দেশ নেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বকে এটা মানতে হবে। এ দেশের নিজস্ব শক্তি, বহুমাত্রিক বন্ধুত্ব ও দৃঢ় নেতৃত্ব উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মডেল এখন। তাই কোনো একটি শক্তি চাইলেই বাংলাদেশ বা সরকারকে ফেলে দেবে—সেই অবস্থা যে আর নেই, সেই বার্তাই প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তার বিভিন্ন বক্তব্যে দিচ্ছেন। এ ছাড়া সরকার ইতোমধ্যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। আগামী সরকারও বাইরের কোনো শক্তি নয়, এ দেশের জনগণ নির্বাচন করবে।