
ভারতের আসাম রাজ্যের দিমা হাসাও জেলার ছোট্ট গ্রাম জাতিঙ্গা। পাহাড়ি গ্রামটি রহস্যময় এক ঘটনার জন্য বিখ্যাত। প্রতিবছর আগস্ট থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে কোনো কোনো রাতে শুধু এ গ্রামটিতেই শত শত পাখি আত্মহত্যা করতে ছুটে আসে। লিখেছেন নিলীমা সুলতানা
সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে পাখিদের এ রহস্যময় ‘গণআত্মহত্যা’র ঘটনাটি ঘটে। নির্দিষ্ট রাতগুলোয় পাহাড়ি খাদে বা আগুনের ওপর ঝাঁপিয়ে জীবন বিসর্জন দেয় এসব পাখি। গ্রামবাসী বিষয়টি বোঝার পর থেকে পাখি শিকারের জন্য দল বেঁধে মশাল নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় অপেক্ষা করে।
অনেক পাখি বিশেষজ্ঞ এবং প্রাণিবিজ্ঞানীরা নানা ধরনের গবেষণা করেও এর সুনির্দিষ্ট কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেননি। একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের এ যুগেও হাজার হাজার পাখির গণআত্মহত্যা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি আত্মহত্যা করতে আসা পাখিদের রক্ষা করতে খাবার দেওয়া হলেও তারা রীতিমতো অনশন করে মারা যায়।
স্থানীয়রা অনেক আগে থেকে এ ঘটনার কথা জানলেও বিশ্ববাসীর নজরে আসে ১৯৫৭ সালে ইপিজির দ্য ওয়াইল্ড লাইফ অব ইন্ডিয়া বইটি প্রকাশ হওয়ার পর। বিখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ সলিম আলীকে নিয়ে লেখক কয়েক মাস জাতিঙ্গা গ্রামে থেকে ঘটনাটি চাক্ষুষ করেছিলেন। বইয়ে উল্লেখ করা হয়, বিশেষত সেপ্টেম্বরের অমাবস্যার রাতগুলোয় এ ঘটনা ঘটে। যেসব রাতে কুয়াশা কিংবা মেঘে আকাশ ঢেকে থাকে সেসব রাত আত্মহত্যার জন্য বেছে নেয় পাখিরা।
১৯৭৭ সালে জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার পাখি বিশেষজ্ঞ ড. সুধীন সেনগুপ্ত জাতিঙ্গায় গিয়ে ঘটনাটি দেখেন। তার পর্যবেক্ষণে তিনি জানান, এ সময়ে শয়ে শয়ে পাখি এ গ্রামের আকাশ থেকে ঝরে পড়ে। ধরা পড়ার পর খুব কম পাখিই পালাবার চেষ্টা করেছিল অথবা খাবার দিলেও খেতে চাচ্ছিল না।
এরপর বেশ কয়েকবার ড. সেনগুপ্ত এ রহস্যের সমাধানের চেষ্টা করেছেন। তার মতে, এ সময়টায় জাতিঙ্গায় বায়ুচাপ ও আবহাওয়ার পরিবর্তন, মাধ্যাকর্ষণ,
ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তন পাখিদের স্নায়ুতন্ত্রে চাপ ফেলতে পারে। রাতে উড়তে অনভ্যস্ত পাখিগুলো ঘুম ভেঙে দিকভ্রান্ত হয়ে এলোমেলোভাবে উড়তে থাকে। আবার গ্রামবাসীদের পাখি শিকারের জন্য জ্বালানো আলোর দিকে তারা দলে দলে উড়ে যায় এবং তাদের শিকারে পরিণত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পাখি আত্মহত্যা করতে আসে তারা কেউই নিশাচর নয়। অর্থাৎ সন্ধ্যা নামার পরই তারা নিজ নিজ আস্তানায় ঘুমিয়ে পড়ে এবং রাতে পথ চলার অভিজ্ঞতাও তাদের নেই।
আসামের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার এইচ পি ফুকন এ রহস্যের সমাধানে এবং পাখিদের বাঁচাতে একবার এগিয়ে আসেন। জাতিঙ্গা গ্রামের প্রান্তে তিনি স্থাপন করেন উঁচু ইস্পাতের টাওয়ার এবং তাতে বসানো হয় জোরালো ইলেকট্রিক লাইট। তারপরও বেশিরভাগ পাখিই গ্রামবাসীদের জ্বালানো আলোর দিকেই ছুটে যাচ্ছিল এবং অল্পসংখ্যক পাখি বৈদ্যুতিক আলোর দিকে এলেও তারাও কিছু খাচ্ছিল না এবং না খেয়ে স্বেচ্ছায় মারা যাচ্ছিল।
আসামের পাখি বিশেষজ্ঞ আনোয়ার উদ্দিন চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ মতে, পাখিগুলো সাধারণত অল্পবয়সী এবং ওড়ার ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। ড. সেনগুপ্ত এবং ফুকনের পর্যবেক্ষণে কয়েকটি জিনিস উঠে আসে। মোট ৩৮টি প্রজাতির পাখির মধ্যে এমন গণআত্মহত্যার ঘটনা দেখা গেছে যাদের কেউই নিশাচর নয়। তা ছাড়া পুরো ঘটনা ঘটে মাত্র দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ২০০ মিটার চওড়া একটি স্থানে। জাতিঙ্গা থেকে দুই কিলোমিটার দূরের অন্য গ্রামের মানুষরা বহু বছর আলোর মশাল জ্বালিয়ে একটি পাখিকেও আকৃষ্ট করতে পারেনি। তাই এ রহস্য আপাতত রহস্যই থেকে গেলো।