নেশার অন্ধকারে পথশিশু

গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পলিথিন আর গামের (টলুইন) সমন্বয়ে তৈরি মাদক ‘ড্যান্ডি’ সেবীর সংখ্যা।
গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পলিথিন আর গামের (টলুইন) সমন্বয়ে তৈরি মাদক ‘ড্যান্ডি’ সেবীর সংখ্যা।ছবি : কালবেলা

মৌলভীবাজারে সর্বনাশা নেশা ড্যান্ডি ও অন্যান্য মাদক সেবনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে শত শত পথশিশুর জীবন। এসব শিশুর বেশিরভাগের বয়স ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে।

দেশে মোট মাদকাসক্তের শতকরা ৪০ ভাগই এখন শিশু-কিশোর। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে এ তথ্য বেরিয়ে এলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস্তব পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। তারই দৃষ্টান্ত মেলে মৌলভীবাজারের পরিস্থিতির দিকে তাকালে।

গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পলিথিন আর গামের (টলুইন) সমন্বয়ে তৈরি মাদক ‘ড্যান্ডি’ সেবীর সংখ্যা। বেশকিছু ড্যান্ডিসেবীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়, পলিথিন ব্যাগের ভেতরে রয়েছে ‘আইকা’ যা জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত এক ধরনের আঠা। পলিথিনে ঢুকিয়ে কয়েকবার ঝাঁকি দিলেই প্রস্তুত। এরপর শুধু নাক লাগিয়ে ঘ্রাণ নেওয়া। এর স্বল্পমূল্যের কারণে পথশিশু ছাড়াও ছিন্নমূল নারী-পুরুষও আসক্ত হচ্ছে। রাস্তাঘাট, পার্ক ও নির্জন এলাকায় নির্বিঘ্নে চলছে এ ড্যান্ডি সেবন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, নিয়মিত ড্যান্ডি সেবনে লিভার, কিডনিসহ ব্রেনের অংশগুলো স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় হতে পারে। ড্যান্ডিসেবী এসব পথশিশু ভিক্ষাবৃত্তি, মাদক বিক্রি, মাদক গ্রহণ করা, চুরি ও পকেট কাটার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশন এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, ময়লা, ছেঁড়া জামা-প্যান্ট পরে শিশুরা ভিক্ষাবৃত্তির জন্য ঘোরাফেরা করছে। তারা মূলত পর্যটকদের জন্য অপেক্ষা করছে। অনেকেরই নাম আছে, কিন্তু পরিচয় নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের সবাই মাদকাসক্ত। বিভিন্ন ধরনের সস্তা নেশায় আসক্ত তারা। আবার তাদের মধ্যে অনেকেই মাদক সেবনের টাকা জোগাড় করতে অনেক সময় জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে।

ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মৌলভীবাজারে ছিন্নমূল শিশুর সংখ্যা ২০ হাজার। এর মধ্যে পরিবারের সঙ্গে বাস করে ১৪ হাজার। বাকি ৬ হাজার শিশু একেবারেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। এসব পথশিশুর বয়স ৮ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করায় ছোট থেকেই এসব শিশু মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। এদিকে এসব পথশিশুর লেখাপড়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মানোন্নয়নে নেই কোনো সরকারি বা বেসরকারি ব্যবস্থা। পথশিশুদের জন্য আগে ইউনিসেফ থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন কাজ করলেও এখন আর কোনো সংগঠনই কাজ করে না। যার কারণে যত দিন যাচ্ছে এসব শিশু আরও বেশি বিপথগামী হয়ে পড়ছে। শুধু এসব পথশিশু নিজেরাই নয়, এ কারণে সামাজিক ব্যবস্থাও পড়ছে হুমকির মুখে।

এ বিষয়ে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ড্যান্ডি নেশার প্রবণতা পথশিশুদের মধ্যেই বেশি। কারণ এ মাদক গ্রহণ করলে সাধারণত ক্ষুধামান্দ্য তৈরি হয়। ফলে তাদের খাবার খেতে হয় না। মূলত খাবারের অভাবের কারণেই ছিন্নমূল এসব পথশিশু ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত হয়। তিনি আরও বলেন, এ অবস্থা থেকে তাদের বের করে এনে একটি সুস্থ-সুন্দর জীবন দেওয়া আমাদের দায়িত্ব, রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এসব নেশার কারণে প্রায়ই টাকা সংগ্রহ করতে তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সোয়েব চৌধুরী বলেন, ড্যান্ডির মতো মরণঘাতী নেশা থেকে শিশুদের মুক্ত করতে আমাদের অধিদপ্তরের একটি টিম আমার নেতৃত্বে কাজ করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। আমরা চাই এসব নিষ্পাপ কোমলমতি শিশুর একটি সুস্থ-সুন্দর জীবন ফিরিয়ে আনতে। সমাজের অন্যসব শিশুর মতো তারাও যেন পড়াশোনা করে ভালোভাবে বাঁচতে পারে সেই চেষ্টা আমাদের অব্যাহত।

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, আমরা শিগগির সমাজসেবা কর্মকর্তার মাধ্যমে আসক্ত এসব পথশিশুর তালিকা তৈরি করব। পরে তাদের মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সহযোগিতায় সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ-সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার চেষ্টা করব। পাশাপাশি তাদের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, এর পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com