শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কুণ্ডেরচর ইউনিয়নের পদ্মাতীরবর্তী চিডারচর এলাকা থেকে অবাধে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। দিন দিন বেড়েই চলছে তাদের এ অবৈধ কাজ। অবৈধ বালুখেকোরা রাতের আঁধারে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পদ্মা সেতুর পিলারের কাছে ঢুকে পড়ে, যা ভবিষ্যতে সেতুর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে—এমনটাই ধারণা ওই এলাকার বাসিন্দাদের।
কুণ্ডেরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন বেপারিসহ স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পদ্মানদীতে আমাদের অধিকাংশ মানুষের ভিটেমাটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় এখানকার লোকজন খুবই কষ্টে বিভিন্ন স্থানে কর্মহীন হয়ে অন্যের জায়গায় কোনোরকম আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন। এ অবস্থায় পদ্মার চরের মধ্যে কিছু ডুবোচর জেগে ওঠায় মানুষের মধ্যে নতুন করে আশার আলো সঞ্চার হয়েছে যে, তারা আবার সেখানে গিয়ে বসবাস করতে পারবেন। কিন্তু একটি কুচক্রী মহল প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে এখান থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে অন্যত্র বিক্রি করে চরগুলোকে ভেঙে দিচ্ছে। এতে মানুষের আশার আলো নিভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাদের এ অপকর্মের জেরে হুমকির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতুও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার এক প্রবীণ জানান, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় এ এলাকার লিয়াকত মল্লিক, লতিফ মল্লিক, বোরহান মল্লিক, নজরুল মল্লিক, রাজ্জাক মাঝি, খবির ফরাজী, লালচান মাতবর, রফিক আকনসহ বেশ কয়েকজন এ অবৈধ কাজ করছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের কালা বাচ্চু, নারায়ণগঞ্জের আরিফ খানসহ অনেকে। তারা এ অবৈধ বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত। তারা সিন্ডিকেট করে পদ্মার বালু লুটেপুটে খাচ্ছে। জাজিরা ছাড়াও শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর আলাওলপুর ও কুচাইপট্টি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থান থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনের মহড়া চলছে। প্রতি রাতে ১৫ থেকে ২০টি ড্রেজার দিয়ে তোলা হচ্ছে বালু।
জাজিরার কুণ্ডেরচর মতো একই দশা গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর, আলাওলপুর ও কুচাইপট্টি ইউনিয়নের। সেখানকার স্থানীয় আব্দুল খালেক সরদার (৬৫) কালবেলাকে বলেন, পৈতৃক সম্পত্তির ১৬৮ শতাংশ জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন আমার মাথা গোঁজার মতো সামান্য একটা ভিটা রয়েছে, নদী থেকে বালু তোলার কারণে তা-ও হুমকিতে রয়েছে। এ চিন্তায় আমি রাতে ঘুমাতেও পারি না।
বৃদ্ধ খালেক সরদারের মতো আরও প্রায় ৪০০ পরিবারের একই অবস্থা এখন। তারা সবাই আশঙ্কা করছেন, বর্ষা এলে শেষ আশ্রয়টুকুও বুঝি আর থাকবে না। চারপাশের পূর্ব কোদালপুর, মাউছাখালী, চর জালালপুর, দক্ষিণ কোদালপুর ও কুচাইপট্টি, আলাওলপুর এলাকাও রয়েছে ঝুঁকিতে।
গোসাইরহাট উপজেলার বালু অবৈধভাবে কারা উত্তোলন করছে, এ তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় ঠান্ডার বাজার এলাকায় বেশ কয়েকটি ড্রেজার নোঙর করে রাখা। ড্রেজারের মালিক কে, তা জানার জন্য স্থানীয়দের কাছে জানতে চাইলে তারা কেউ প্রভাবশালীদের ভয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, এখানে দুই-এক দিন থাকেন সব প্রশ্নে উত্তর পেয়ে যাবেন। রাত ৮টার পরই দেখবেন, বালু তোলার মহোৎসব শুরু হয়। রাত হলেই ড্রেজার আসে মাঝের চর পয়েন্টে, প্রায় ৫০টি কার্গো ও ট্রলার ভর্তি করে ভোররাত পর্যন্ত চলে এ কর্মযজ্ঞ। তারা মাসে প্রায় কোটি টাকার বালু বিক্রি করছে।
কারা বালু উত্তোলন করছেন, প্রশ্ন করলে অবৈধ বালু উত্তোলন প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক তাজকির আহম্মেদ দেওয়ান বলেন, ‘বালু উত্তোলনের ঘটনা শরীয়তপুরের সব মানুষ জানে, বিশেষ করে আমার গোসাইরহাট উপজেলার সব স্তরের মানুষ এ বালুচোরদের বিরুদ্ধে এক হয়ে আন্দোলন করেছেন, তারা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন, নদীতীরে মানববন্ধন করেছেন, রাত জেগে নদী পাহারা দিয়েছেন। প্রশাসন কয়েকবার তাদের এগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, তার পরও তারা এগুলো করে যাচ্ছেন।’ তবে তারা সবাই সরকারি দলের হাইব্রিড নেতাদের আত্মীয় এবং সরকারে সাবেক এক প্রভাবশালী আমলার নামও আছে। তারা কারা, প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবাই জানে, তারা কারা, আমি তাদের নাম বলব না, আপনারা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে যান, তাদের কাছে বালুচোরদের তালিকা আছে।’
এ বিষয়ে জাজিরা, গোসাইরহাট ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারা কালবেলাকে বলেন, অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলনের অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। এরই মধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি ড্রেজার জব্দ করেছি এবং এর সঙ্গে জড়িতদের আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছি। তা ছাড়া এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।