ছনের ঝুড়ি-বাটির বিদেশযাত্রা

বগুড়ার শেরপুরে বিভিন্ন গ্রামে ছন-তালপাতা আর সুঁই দিয়ে রকমারি পণ্য তৈরি করেন নারীরা।
বগুড়ার শেরপুরে বিভিন্ন গ্রামে ছন-তালপাতা আর সুঁই দিয়ে রকমারি পণ্য তৈরি করেন নারীরা।ছবি : কালবেলা

বগুড়ার শেরপুরের গাড়ীদহ ইউনিয়নের একটি গ্রাম হাপুনিয়া। এ গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে কোথাও সারিবদ্ধভাবে আবার কোথাও এলোমেলোভাবে বসেছেন নারীরা। একাগ্রচিত্তে হাতে থাকা সুঁইয়ের ফোঁড়ে ফোঁড়ে গাঁথছেন ছন আর তালপাতা। তাদের হাতের কারিগরিতে ছন-তালপাতা যেন নিমিষেই ঝুড়ি, বাটি, ডালা, ট্রে, পাটিসহ বিভিন্ন নান্দনিক পণ্যের রূপ নিচ্ছে।

বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম শেরুয়া ও ধড়মোকাম থেকে শৌখিন হস্তশিল্প পণ্য তৈরির কর্মযজ্ঞ এখন ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলার গাড়ীদহ, শাহবন্দেগী, কুসুম্বি, খানপুর, বিলাশপুরসহ ১০ ইউনিয়নের আরও ৪০টি গ্রামে। এসব গ্রামের ৮ থেকে ১০ হাজার নারী জীবিকা নির্বাহ করছেন ছন ও তালপাতা দিয়ে বিভিন্ন নান্দনিক পণ্য বানিয়ে। এ ক্ষেত্রে পুরুষরা অনেকটা সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তাদের হাতে তৈরি এসব পণ্য যাচ্ছে আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এতে একদিকে গ্রামীণ নারীরা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছেন, অন্যদিকে এসব পণ্য রপ্তানি করে দেশে আসছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।

স্থানীয়রা জানান, ১৯৮৫ সালে ঢাকা থেকে আসা একজন ব্যবসায়ী শেরুয়া ও ধড়মোকাম গ্রামের নারীদের হাতে তুলে দেন কাশফুলের খড়, ছন ও তালপাতা। সেখান থেকেই শুরু। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ হস্তশিল্প ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। একসময় তাদের তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে শুরু করেন ওই ব্যবসায়ী। এরপর একে একে এ শিল্প নিয়ে কাজ শুরু করে বেশ কয়েকটি বেসরকারি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, নারীদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহের জন্য প্রতিটি গ্রামে রয়েছে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর এজেন্ট। সেইসঙ্গে ১৫ থেকে ২০০ জনকে নিয়ে গঠিত হয় সমিতি। চাহিদামতো পণ্য তৈরি করে দলপ্রধানের মাধ্যমে এজেন্টের কাছে দেন সমিতির নারীরা। অনেকে আবার এজেন্টদের কাছ থেকে তালপাতা, ছন এবং পাটের সুতাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল সংগ্রহ করেন। পণ্য বিক্রির পর এসব কাঁচামালের অর্থ ফেরত দেন তারা। ফলে অতিরিক্ত মূলধনেরও প্রয়োজন হয় না।

রাবেয়া খাতুন, শামসুন্নাহার, মৌমিতা রায় নামে কয়েকজন হস্তশিল্পী জানান, ঝুড়ি তৈরির কাঁচামাল তালপাতা আসে পাশের উপজেলা দুপচাঁচিয়া ও কাহালু থেকে। ছন আসে ধুনট, সারিয়াকান্দি ও সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুরের যমুনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চল থেকে। প্রথমে তালগাছের পাতা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আঁশ বের করা হয়। সংসারের কাজের পাশাপাশি তাদের গ্রামের ৯৫ ভাগ নারীই এই কাজের সঙ্গে জড়িত বলেও জানান তারা।

তবে গ্রামীণ এ হস্তশিল্পীদের অভিযোগ, কষ্ট করে পণ্য তৈরির কাজটা তারাই করেন; কিন্তু মোটা অঙ্কের লাভ চলে যায় স্থানীয় এজেন্টদের হাতে। তালপাতার একটি ঝুড়ি ও লন্ডি ঝুড়ি তাদের কাছ থেকে আঁকার ভেদে ২০০ থেকে ৪৫০ টাকায় কেনেন এজেন্টরা। আর রপ্তানিকারকদের কাছে বিক্রি করেন ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। বিড়াল-কুকুরের ঝুড়ি ১৩০ থেকে ১৬০ টাকায় এজেন্টদের কাছে বিক্রি করেন তারা। এজেন্টরা ২৩০ থেকে ২৭০ টাকায় বিক্রি করেন। ন্যায্য মজুরি পেলে নারীরা এ পেশায় আরও আগ্রহী হয়ে উঠবেন বলেন মন্তব্য করেন তারা।

ব্যবসায়ীরা জানান, উন্নত দেশগুলো হস্তশিল্পের এসব পণ্যের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। পরিবেশসম্মত হওয়ায় আগামীতে এগুলোর চাহিদা আরও বাড়বে।

শেরপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ওবাইদুল হক বলেন, উপজেলায় যারা নারী উদ্যোক্তা আছেন, তাদের অনেককেই সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া হয়। উপজেলা পর্যায় থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। সরকারিভাবে যেসব প্রকল্প দেওয়া হয়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্যোক্তাদের মাঝে তা বণ্টন করা হয়।

বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, নারীদের তৈরি হস্তশিল্প পণ্য বিদেশের বাজারে বেশ সমাদৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিশ্ববাজারে বগুড়া আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com