
গল্প পড়ে বা সিনেমা দেখে যতটা বোঝা যায়, তারচেয়ে বেশি অনুভব করা যায় সত্যিকারের গল্প শুনে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা মাত্রই অন্যরকম এক রোমাঞ্চ ভর করে আমাদের মননে। দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীর শোনা এমন কিছু যুদ্ধের গল্প রইল এবার।
শীতের রাতে তুমুল লড়াই
মো. হায়দার রহমান রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আমার বাবা ১৯৭১ সালে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেছিলেন। আমাদের বাড়ি সীমান্ত অঞ্চলে হওয়ায় ভারত ছিল কাছে। মে মাসে বাবা সেখানে ট্রেনিং নিতে যান। ২৮ দিনের ট্রেনিং শেষে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। উত্তরবঙ্গের নভেম্বর ও ডিসেম্বরের কনকনে শীতেও তাদের অনেক নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছিল। সম্মুখ সমরের কথা বলতে গিয়ে বাবা বলেন, মির্জাগঞ্জে যা ঘটেছিল তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তাদের দলের সবাই একটি মিলিটারি ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিশ্চিত ছিলেন সবাই মারা গেছেন।
উল্লাসে ফিরছিলেন তারা। কিছুটা দূরে অবস্থানরত বেঁচে যাওয়া কিছু পাকিস্তানি আর্মি তখন আচমকা পেছন থেকে গুলি চালায়। সঙ্গে থাকা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেখানেই শহীদ হন।
যুদ্ধটা তার ছদ্মনামে
সানজিদা আলম তান্নি, ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট-নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বাবার মুখে শুনি যুদ্ধকালীন গল্প। তিনি বলেন, ‘আমি যখন ক্লাস নাইনে, তখন দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি। পত্রিকায় বাঙালির ওপর নিপীড়নের খবর আমার মনে ক্ষোভ জাগায়। ঠিক করি যুদ্ধে যাব। এদিকে পকেটে নেই টাকা। ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বাবার গোয়াল থেকে একটা ছাগল নিয়ে যাই বিক্রির জন্য। ওই টাকাই ছিল সম্বল। ওটা নিয়ে ভারতে যাই দুই ভাই। প্রশিক্ষণ শেষে ২ নম্বর সেক্টরে নাম লেখাই। ছদ্মনাম লিখি—দিদারুল আলম। তা না হলে পরিবারের ওপর আঘাত আসতে পারত। আমার আসল নাম সিফাত উদ্দিন।’ পরে আমার দাদা অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমার চাচা বাড়ি চলে গেলেও বাবা থেকে যান ময়দানে। শেষদিকে একবার পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্পে হামলা করেন তাদের ১০ জনের একটি দল। ওটাই বাবার জীবনে স্মরণীয় ঘটনা।
মোহন বর্ম্মণের মিশন
গোপাল রায়, গ্রাফিকস ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
একটি গল্প শুনেছি তখনকার তরুণ মুক্তিযোদ্ধা হীরা মোহন বর্ম্মণের কাছ থেকে। ট্রেনিং নিয়েছেন ভারতে। অনেকেই ট্রেইনারদের ইংরেজি ও হিন্দি বুঝত না। মোহন বর্ম্মণ বিএ ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ভাষাগুলো বুঝতেন বলে তাকে ট্রেইনার হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তিনিসহ সাতশ মুক্তিযোদ্ধা একসঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। শুরুতেই তারা একটি পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে তিনটি মেয়েকে উদ্ধার করেন। এ সময় একজনকে সন্দেহ হলে তাকে চোখে চোখে রাখেন মোহন। ওই লোক একটি যাত্রা দলে ছিল। মোহন জানতে পারলেন ওই লোক ছদ্মবেশে আছে। সে মূলত পাকিস্তানের গোয়েন্দা। মোহন ও তার এক বন্ধু অস্ত্রসহ ওই লোকের পিছু নেন। ওই লোক এক বাড়িতে ঢুকলে তারা দুজনই গুলি চালান। মারা যায় ওই গুপ্তচর।
স্কুল থেকে যুদ্ধে
মো. আব্দুল হান্নান শিমুল, পুরকৌশল বিভাগ- ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
বাবা যখন যুদ্ধে যান তখন নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। বাবা যুদ্ধে যাবেন; কিন্তু দাদু কিছুতেই দেবেন না। এক দিন পকেটে তিন কি চার আনা নিয়ে স্কুলে গিয়েছিলেন; কিন্তু ঘরে ফেরেননি। দাদু ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিতে বুক ভাসান। বাবার সঙ্গী ছিলেন হাতিম ও নিজাম নামের দুজন। তারা পথে এক রাজাকারের খপ্পরে পড়েন। অবশ্য তিনজন সেই রাজাকারকে পরাস্ত করেন। এক দারোগা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে বাঘমারা ইয়ুথ ক্যাম্পে পাঠান। সেখানে ১৭ দিন খিচুড়ি খেয়ে থাকতে হয়। এরপর তোরা নামের এক জায়গায় নিয়ে ৩১ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে ভারী অস্ত্র হাতে দিয়ে বিজয়পুর ক্যাম্পে যান যুদ্ধ করতে। ফেরার পথে পাকিস্তানি মিলিটারিদের পুঁতে রাখা ৭টি মাইনের সন্ধান পান বাবারা। বলা যায়, অল্পের জন্য সেই যাত্রায় তারা বেঁচে যায়।
একটাই মেশিনগান
হাসান মোহাম্মদ সাকিব,ইতিহাস বিভাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বারান্দায় বসে গান শুনছিলেন নানা। ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ শেষ হতেই তিনি বললেন, একাত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সালদা নদীর তীরে যুদ্ধ করেছিলেন তারা। টানা দুদিন বৃষ্টির মতো বুলেট ছুড়েছিল পাকিস্তানি আর্মিরা। দুই দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছিল তাদের। তৃতীয় দিন রাতে সামান্য আধপাকা কলা খেয়ে কোনোমতে পেটকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তারা। নানা বললেন, তাদের ওস্তাদ মর্টারম্যান মতিন। তার কাছে মেশিনগান ছিল। ওই রাতেই একটি গোলা এসে আঘাত করলে পা উড়ে যায় মতিনের। পুরো দলে ভারী অস্ত্র বলতে ওই একটি মেশিনগানই ছিল। আর সেটা চালানোর মতো কেউ ছিল না। সে রাতে নানাদের লক্ষ্য ছিল ভোর পর্যন্ত সামাল দেওয়া। কুপি নিভিয়ে বসে ছিলেন নানা ও সঙ্গীরা। মিলিটারিরা ২০টি গুলি ছুড়লে তারা ছুড়তেন দুটি। সকালে মিলিটারির গুলি ফুরিয়ে এলে নানারা হামলা চালান। দখল করেন ক্যাম্পটি।
আত্মসমর্পণ করেছিল ওরা
ফাতেমা তুজ জোহরা, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের ১৯৬৭-৬৮ সেশনের শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতা ছিল আমার প্রয়াত পিতা ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সি আব্দুল হালিম। পরিবারের বড় সন্তান বাবা ছোট থেকে ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। তাই আমার দাদা তাকে এক বন্ধুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে না গিয়ে বাবাসহ ৬-৭ জন চলে যান ভারতে। মিলিটারিরা এই খবর পেলে দুবার আসেন দাদাকে হত্যা করতে। যুদ্ধের শেষদিকে ৮ ডিসেম্বর লোহাগড়া ও ৯ ডিসেম্বর কালিয়া থানা শক্রমুক্ত হলেও নড়াইল থানা ছিল পাকিস্তানিদের অধীনে। তখন বাবাসহ অনেক যোদ্ধা চলে আসেন যুদ্ধ করতে।
বাবার সহযোদ্ধা মতিউর রহমান শহীদ হন। ১০ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে ২২ জন পাকিস্তানি সেনা ও ৪৫ জন রাজাকার অস্ত্রসহ আমার বাবা ও সহযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
আশ্রয় দিয়েছিলেন দাদা
রেদ্ওয়ান আহমদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের গ্রাম শ্রীমঙ্গল কান্দি। বানিয়াচং উপজেলার একটি গ্রাম। একাত্তরের গল্প আমি শুনেছি মূলত বাবার মুখে। ওই সময় গ্রামটিতে হিন্দুদের বাস ছিল বেশি। বিখ্যাত জমিদার বৃন্দাবন রায় এ গ্রামেরই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অধিকাংশ হিন্দু গ্রাম ছেড়ে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধ চলছিল যখন, তখন রাজাকারদের দেওয়া তথ্যে পাকিস্তানি সেনারা হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। ওই সময় গ্রামে আমার দাদার বেশ নামডাক ছিল। সবাই তাকে হাজি সুন্দর আলী নামে চিনত। গ্রামের সবাই সমীহও করত দাদাকে। তাই, হিন্দুদের অনেকেই ওই সময় আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দাদাই তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। পাড়ায় দাদার বেশ দাপট ছিল বলে বাইরের কারও বাড়িতে ঢোকার সাহসই হতো না। নিজের ও পরিবারের জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও আমার দাদা তাদের সবাইকে নিরাপদে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
আশ্রয় পেতে বিয়ে
লিমা আক্তার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ-জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
যুদ্ধের কয়েক মাস আগে আমার নানা-নানির বিয়ে হয়। ভালোই দিন যাচ্ছিল; কিন্তু দেশ যখন চরম বিরূপ পরিস্থিতে, নানা বললেন তিনি যুদ্ধে যাবেন। নানিকে প্রশ্ন করেন, তিনি মারা গেলে নানি কী করবেন? নানি বলেছিলেন, ‘একাই জীবন কাটাব’। পরে নানা যে এলাকায় ট্রেনিং নিয়েছেন, সেখানে ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাস। কিন্তু আশ্রয় পেতে নানা সেখানকারই এক মেয়েকে বিয়ে করেন। নানা যে মুসলমান ছিলেন সেটা মেয়েটিই শুধু জানত। পরে অবশ্য দেশ স্বাধীন হলে সমঝোতার ভিত্তিতে তাদের ছাড়াছাড়ি। নানা বলেছেন, মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিতে তার খারাপই লেগেছিল। পরে সেই কষ্ট ভোলেন বাড়ি ফেরার পর। কেননা বাড়ি ফিরেই নানা দেখেন তার ফুটফুটে কন্যাসন্তানের মুখ। নানিকে তিনি ওই বিয়ের কথা বলেছিলেন। পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে নানি সেটা মেনেও নিয়েছিলেন তখন।