
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ বেশ পুরোনো। মাঝে মাঝেই এটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দেশ দুটির মধ্যে বিরোধ আরও বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে রয়েছে। কিন্তু চীন কখনো এ যুদ্ধের বিরোধিতা করেনি, উল্টো সব সময় রাশিয়াকে নীরব সমর্থন করে গেছে। সম্প্রতি বেলুনকাণ্ড নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে চীনকে শায়েস্তা করতে অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন দিতে সম্মত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে দেশটির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে আরেক পশ্চিমা দেশ ব্রিটেন। স্থানীয় সময় গত সোমবার এ তিন দেশের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো নৌঘাঁটিতে নতুন নিরাপত্তা চুক্তি সই করেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হবে। এটা হবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। খবর বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরার।
গত সোমবার এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আধিপত্য অর্থাৎ চীনের সামরিক অগ্রগতি ঠেকাতে নতুন এ পরিকল্পনা হাতে নেয় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সান দিয়েগো নৌঘাঁটিতে এ তিন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা অকাস জোটের নতুন পরিকল্পনা গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন।
অকাসের নতুন চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন তিনটি সাবমেরিন কিনবে অস্ট্রেলিয়া। প্রয়োজন মনে করলে অস্ট্রেলিয়া আরও দুটি ভার্জিনিয়া শ্রেণির সাবমেরিনও কিনতে পারবে। এগুলোর প্রথম চালান আগামী ১০ বছরের মধ্যে পৌঁছাবে অস্ট্রেলিয়ার কাছে। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়াকে এসএসএন-অকাস মডেলের সাবমেরিন দেবে ব্রিটেন। এগুলো ব্রিটেনের নকশা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিতে তৈরি হবে। যুক্তরাষ্ট্র এর আগে সবশেষ পারমাণবিক সাবমেরিন প্রযুক্তি বিনিময় করেছিল ১৯৫৮ সালে ব্রিটেনের সঙ্গে।
ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ চুক্তি এক মোড় বদলকারী ঘটনা, যা পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেবে। কারণ, পৃথিবীতে বর্তমানে মাত্র ছয়টি দেশের হাতে পারমাণবিক সাবমেরিন আছে। দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ভারত।
পরমাণু-শক্তিচালিত সাবমেরিন শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে গভীর সমুদ্রের নিচে ডুবে থাকতে এবং দ্রুত চলাচল করতে সক্ষম। এর উপস্থিতি চিহ্নিত করাও অনেক কঠিন। এ সাবমেরিন কোনো রিফুয়েলিং ছাড়াই মাসের পর মাস পানির নিচে থাকতে পারে। এগুলো অনেক বেশি ক্ষেপণাস্ত্র বহন এবং তা অনেক বেশি দূর পর্যন্ত নিক্ষেপ করতে সক্ষম। এ ধরনের সাবমেরিন পেলে অস্ট্রেলিয়ান সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। তারা প্রশান্ত মহাসাগরের বহুদূর পর্যন্ত এলাকায় গোপন নজরদারি ও টহল দিতে পারবে। অস্ট্রেলিয়ার মতে, এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব ও হুমকি এতটাই বেড়ে গেছে যে, তা মোকাবিলা করতে হলে এমন অস্ত্র তাদের প্রয়োজন।
বিশ্লেষকদের মতে, পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী নয়—এমন একটি দেশকে এ ধরনের সাবমেরিন দেওয়ার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব বহন করে। অস্ট্রেলিয়াকে এ প্রযুক্তি দেওয়ার পেছনে চীনকে ঠেকানো ছাড়া আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। যদিও ওয়াশিংটন ও লন্ডন এ ধরনের দাবি উড়িয়ে দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা অধ্যাপক হিউ হোয়াইট বলেন, বিশ্ব নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এ অনুভূতি গভীর হচ্ছে যে, এশিয়ায় সত্যি এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধ হচ্ছে এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্র জিতবে বলে অস্ট্রেলিয়া বাজি ধরেছে। চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ব্যবস্থার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়াকে যুক্ত করার অর্থ হলো এ ধারণাকে আরও গভীর করা।
অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরি সরকারের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সিনিয়র পরিচালক গাই বোকেনস্টাইন বলেন, এটা এক বিরাট চুক্তি। এ তিনটি দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ মোকাবিলায় কাজ শুরু করল। চুক্তিটিতে এ তিন দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য এবং কোয়ান্টাম প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি বিনিময়ের কথাও আছে। তবে মূল বিষয় হলো পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার কাছে বিক্রি করা হবে টোমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে এ তিন দেশ অকাস চুক্তির ঘোষণা দেয়। এ চুক্তির আওতায় নিজেদের মধ্যে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার যুদ্ধের সরঞ্জামসংক্রান্ত সহযোগিতা সরবরাহের কথা রয়েছে। তবে শুরু থেকেই এ চুক্তির তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছে চীন। দেশটির দাবি, অকাস চুক্তির মাধ্যমে নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি (এনপিটি) বা পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তির দুর্বলতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে।