খেলাপির নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেন শীর্ষ নির্বাহীরা

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।পুরোনো ছবি

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, করপোরেট সুশাসন ও খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি বলেন, সুশাসন নিশ্চিত ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের শক্তিশালী ভূমিকাই খেলাপি ঋণ সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর এক হোটেলে উদ্বোধন হওয়া দুদিনব্যাপী ‘ব্যাংকিং অন ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক সম্মেলনের উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন।

এর আগে গত সোমবার ‘ব্যাংকিং সেক্টর আউটলুক-২০২৩’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যিক ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন খেলাপি ঋণকে দেশের অন্যতম চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এই চ্যালেঞ্জকে শুধু ব্যাংকাররা বা বাংলাদেশ ব্যাংক মোকাবিলা করবে; সেই পর্যায়ে এই সমস্যাটি আর নেই। এটি ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

এবিবির এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই গভর্নর এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে করপোরেট সুশাসন ও খেলাপি ঋণ। এর সমাধানে আমাদের প্রয়োজন ব্যাংকিং আচরণে নৈতিকতার চর্চা, ব্যাংক কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও সুশাসন নিশ্চিত করা। ব্যাংকিং নীতিমালার বাস্তবায়ন ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের শক্তিশালী ভূমিকা খেলাপি ঋণ সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ‘দূরদর্শী নীতিমালা’ প্রণয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ব্যাংকিং খাতে ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহার বাড়ছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব ডেবিট কার্ড চালু করতে যাচ্ছে। আমরা খুব কাছেই চলে এসেছি নিজস্ব ডেবিট কার্ড চালু করতে। বর্তমানে ভিসা, মাস্টার কার্ডের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ব্যাংকগুলোকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লেনদেন করতে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড সেবা দিচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে তারা লভ্যাংশ হিসেবে প্রতিবছর। বাংলাদেশের নিজস্ব ডেবিট কার্ড চালু হলে কার্ডভিত্তিক লেনদেনে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা কমে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকরা দৈনিক ১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন এটিএম বুথ ও পজ মেশিনের মাধ্যমে। মোট লেনদেন হয়েছে ওই মাসে ৪২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত ৩ কোটি ৯ লাখ ৯৭ হাজারের বেশি কার্ড ইস্যু করেছে বিভিন্ন ব্যাংক। বর্তমানে সবাই গ্লোবাল ভিলেজে বসবাস করছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, ব্যাংকারদের বিষয়ে সচেতন করতে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আগামী ২০২৭ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের সব ধরনের লেনদেন ৭৫ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংকেরই কোর ব্যাংকিং সল্যুশন সফটওয়্যার ব্যবহার করছে।

ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের ফলে ব্যাংকিং ব্যবসায় বৈচিত্র্যকরণ চলে আসবে। এজন্য ব্যাংকিং আচরণেও পরিবর্তন হবে জানিয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ব্যাংকিং খাতে নতুন যে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, তার জন্য ব্যাংকগুলোকে আরও প্রস্তুতি নিতে ‍গুরুত্ব দিতে আহ্বান জানান গভর্নর।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে প্রথমবারের মতো এবিবির উদ্যোগে আয়োজিত এই সেমিনারে চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী এবং এবিবির কোষাধ্যক্ষ ও মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি মো. আহসান-উজ জামানসহ বিভিন্ন ব্যাংকের এমডিরা এতে অংশগ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠানে এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, আগামী দিনের সেবা মানেই ডিজিটাল সেবা। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা এই সেবায় অনেক পিছিয়ে আছি। এমন তাগিদ থেকেই এই সম্মেলনের আয়োজন করেছি। এর মাধ্যমে আর্থিক অনিয়ম দূর করে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে জানিয়ে তিনি বলেন, একটি একীভূত লক্ষ্যের দিকে একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থিক সেবা খাত একটি টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইকোসিস্টেম তৈরি করতে পারে, যা সব স্টেকহোল্ডারের উপকারে আসবে। তিনি বলেন, দেশের ডিজিটাল আর্থিক সেবার প্রবৃদ্ধি কীভাবে ত্বরান্বিত হতে পারে, সম্মেলন থেকে তা নিয়ে পর্যবেক্ষণ উঠে আসবে। ডিজিটাল রূপান্তর দ্রুত নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহণে সহায়তা করবে এটি।

এবিবি দেশে ডিজিটাল আর্থিক সেবার প্রবৃদ্ধি অর্জনের মূল গতিধারাগুলো নিয়ে মূল্যবান পর্যবেক্ষণ প্রদানের জন্য দুদিনব্যাপী এই সম্মেলনের আয়োজন করে। ৪৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ১৫০ জনের বেশি কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করছেন। সম্মেলনে এবিবি এবং পিডব্লিউসি যৌথভাবে ‘ব্যাংকিং ইভলুশন: ড্রিভেন বাই ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য গৃহীত কৌশলগুলো বিশ্লেষণ করতে বিভিন্ন ব্যাংকের সিএফও পর্যায়ের নির্বাহীদের নিয়ে একটি জরিপ স্থান পেয়েছে। সম্মেলনে ডিবিএস সিঙ্গাপুর, ইঅ্যান্ডওয়াই, আইবিএম, বাংলাদেশ ব্যাংক, গ্রামীণফোন, ইউনিলিভার, হুয়াওয়ে, ওরাকল, আইটি কনসালট্যান্ট, লেন্ট্রা, থাকরাল, ওরোজেনিক, মাস্টারকার্ড, কেপিএমজি, ডেলয়েট, এটুআই, বিআইবিএমসহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানি এবং সংস্থার বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সেশন পরিচালনা করছেন। সম্মেলনের লক্ষ্য বাংলাদেশে ডিজিটাল আর্থিক সেবার প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা এবং প্রধান গতিধারাগুলোর ওপর আলোকপাত করা। দ্রুত ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্যে পথ চলতে ব্যাংকগুলো যে কৌশল গ্রহণ করতে পারে, তা বিশ্লেষণ করে মূল্যবান পর্যবেক্ষণ প্রদান করা সম্মেলনের লক্ষ্য।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com