হাতে বানানো গহনা

মডেল: লিন্ডা আয়েশা; মেকআপ: পারসোনা; গহনা: স্বাক্ষর বাই নওরিন; ছবি: রনি বাউল
মডেল: লিন্ডা আয়েশা; মেকআপ: পারসোনা; গহনা: স্বাক্ষর বাই নওরিন; ছবি: রনি বাউল

চারুকলায় পড়ার সময়ই ফ্যাশন ব্র্যান্ড দেশাল-এ খণ্ডকালীন ডিজাইনার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন নওরিন জাহান। পরে পুরো দমে ডিজাইনার হিসেবে দীর্ঘ ১০ বছর কাজ করেন সেখানে। তবে একটা সময় তার ইচ্ছে জাগে নিজের জন্য কিছু করার। তাইতো চাকরি ছেড়ে কাজ শুরু করেন হ্যান্ডমেইড গহনা নিয়ে। গহনার ব্র্যান্ডের নাম দেন- স্বাক্ষর বাই নওরিন। লিখেছেন বৃষ্টি শেখ খাদিজা

মানুষ যেদিন মানুষ হলো, সেদিন থেকেই গহনার শুরু। হাজার বছর ধরে মানুষ নিজেকে খানিকটা ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার করছে এটি। আর শুরুর দিকে তো ছিল না বড় প্রতিষ্ঠান বা যন্ত্রপাতি। তখন মানুষ নিজেই বানাতো নিজের গহনা। হ্যান্ডমেইড সেই গহনার কদর কিন্তু কমেনি আজও।

সৌন্দর্য বৃদ্ধি হোক বা নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ; গহনা লাগবেই। যুগের সঙ্গে গহনার রং, নকশা, মোটিফ ও উপাদানে এসেছে ভিন্নতা। এই সময়ে বদলেছে রুচিবোধ, ফ্যাশন ও চাহিদা। একটা সময় গহনা বলতে লোকে বুঝত সোনা, রুপা বা দামি পাথর। এখনকার ফ্যাশনপ্রেমীরা চায় ভিন্ন কিছু। ভারী গহনার চেয়ে হালকা অথচ স্টাইলিশ এমন বিকল্প গহনাতেই এ যুগের তরুণীরা সাবলীল।

মেটাল, সুতা, কড়ি, রুদ্রাক্ষ, পুঁতি, ঝিনুক ও বিডসের নানারকম গহনা এখন জনপ্রিয়। এ ছাড়া কাপড়, কাঠ, বোতাম, প্লাস্টিক, ধাতব পদার্থ ইত্যাদি উপাদানে হ্যান্ডমেইড গহনাও বানাচ্ছেন ডিজাইনাররা। তাদেরই একজন নওরিন জাহান। চারুকলায় পড়ার সময়ই ফ্যাশন ব্র্যান্ড দেশাল-এ পার্টটাইম ডিজাইনার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। পরে ফুলটাইম ডিজাইনার হিসেবে ১০ বছর কাজও করেছিলেন। একটা সময় ইচ্ছে জাগে নিজে কিছু করার। তাই চাকরি ছেড়ে কাজ শুরু করেন হ্যান্ডমেইড গহনা নিয়ে। নিজের ব্র্যান্ডের নাম দিয়েছেন—স্বাক্ষর বাই নওরিন।

হ্যান্ডমেইড গহনা বলতে মূলত কী বোঝায়? এ প্রশ্নে নওরিন বলেন, আমাদের দেশে যেসব ফ্যান্সি বা কৃত্রিম জুয়েলারি আছে তার বেশিরভাগ মেশিনে তৈরি। হাতে তৈরি বলতে বোঝায় সেসব গহনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হাতে বোনা। এ গহনাগুলোর জোড়া থেকে শুরু করে কানেক্টর সবই হাতে তৈরি হয়। সনাতন পদ্ধতির কথা যদি বলি, সোনা বা রুপার গহনা ডিজাইন করার জন্য যেসব ডাইস ব্যবহার করা হয় সেগুলোও কিন্তু হাতে তৈরি। কিন্তু মেশিনমেইড গহনাগুলো জোড়া হোক বা কানেক্টর, সবকিছু মেশিনে হয়।

মেশিনমেইড ও হ্যান্ডমেইড গহনার একটি বড় পার্থক্য হলো—মেশিনে একসঙ্গে অনেক গহনা তৈরি করে নেওয়া যায়। আর একই ধরনের গহনা হাতে বানাতে চার-পাঁচ দিনও চলে যায়। তাই এর বাজারমূল্য একটু বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করেন এ ডিজাইনার।

নওরিন বলেন, দেশের অনেক ক্রেতা হ্যান্ডমেইড গহনা সম্পর্কে জানেন না। আমি যেহেতু সবসময় আমার তৈরি গহনাতে ভিন্নতা দেওয়ার চেষ্টা করছি, তাই এগুলোর দাম একটু বেশি হয়। তবুও চেষ্টা করি সাধ্যের মধ্যে দেওয়ার।

তার মতে, হাতে তৈরি গহনায় মৌলিকত্ব থাকে। কারণ, এতে শ্রম ও সময় জড়িত। কিন্তু দুঃখের বিষয়—আমাদের দেশে হাতে তৈরি গহনার বাজারমূল্য কম। এর উল্টোটা হওয়ার কথা ছিল। দেখা যায় আর্টিফিশিয়াল গহনার জন্য ক্রেতারা বেশি দাম দিচ্ছেন। কারণ তারা বলেন, এটা তো হাতে বানানো, এর এত দাম হবে কেন? এটি তো দেশি গহনা, এর কেন এত দাম? এমন প্রশ্নের মুখোমুখিও হতে হয়েছে।

একটি গহনা তৈরির সময় পুঁতি গাঁথা থেকে শুরু করে ফোঁড় তোলা সবকিছু হাত দিয়েই করতে হয়। যদি দশটি গহনা তৈরি করি তাহলে আমাকে দশবার একই কাজ করতে হয়।

হ্যান্ডমেইড গহনার মূল্য কীভাবে নির্ধারণ করা হয়? নওরিন জানালেন, একটি গহনা বানানোর জন্য কী কী উপকরণ লাগছে এবং কতটুকু সময় লাগছে দামটা সেটার ওপর নির্ভর করে।

উপকরণ কোথা থেকে সংগ্রহ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার গহনার বেশিরভাগ উপকরণ প্রাকৃতিক বীজ। আমাদের দেশে যা পাওয়া যায় সেটা দিয়েই চেষ্টা করি। ভিন্নতার প্রয়োজন হলে কিছু উপকরণ বাইরে থেকে নিয়ে আসি। বিশেষ করে নেপাল থেকে।

হ্যান্ডমেইড গহনার জন্য কী ধরনের বীজ বা উপকরণ ব্যবহার করা হয়? উত্তরে নওরিন জাহান বলেন, কড়ি বেশি ব্যবহার করি। আছে রুদ্রাক্ষ, পুঁতি, ঝিনুক, রক্তচন্দন বীজ, রাবার গোটা, পদ্মবীজ, এলাচ, সুতা, নারিকেলের খোল ইত্যাদি। প্রকৃতিতে অনেক মজার উপকরণ আছে। আমার গহনায় আর্টিফিশিয়াল কিছু থাকে না বললেই চলে।

প্রাকৃতিক এসব গহনার স্থায়িত্ব কেমন? নওরিনের উত্তর—যে কোনো জিনিসের স্থায়িত্ব নির্ভর করে যত্নের ওপর। হ্যান্ডমেইড গহনাগুলো একটু স্পর্শকাতর হয়। সুতি কাপড় দিয়ে যে গহনাগুলো তৈরি করি তা ঘামের সংস্পর্শে বা পানিতে ভিজলে তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া বীজ দিয়ে যেসব গহনা তৈরি করা হয় সেগুলোও ভেজানো যাবে না। এ জন্য হ্যান্ডমেইড গহনা ব্যবহারের পর সেটি ভালোভাবে শুকাতে হবে। রোদেও তুলে রাখতে হবে। ভালো হয় টিস্যু পেপারে মুড়িয়ে বাতাসরোধী বাক্সে রাখলে।

নওরিন বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হ্যান্ডমেইড গহনার অনেক কদর। আমাদের এখানে দেশের বাইরে গহনা পাঠাতে হলে অনেক খরচ হয়। তবে কোনো ক্রেতা যদি শিপিং চার্জ দিতে পারেন তাহলে আমরা গহনা পাঠিয়ে দিই।

সঙ্গে যোগ করেন, আমাদের দেশে পোশাকের বিষয়টি অনেক বিস্তৃত। গহনা পিছিয়ে আছে। প্রচার-প্রচারণা কম, তাই হ্যান্ডমেইড গহনার কদরও কম। মাঝেমধ্যেই পোশাকের র‌্যাম্প শো হয়। একইভাবে গহনা নিয়েও শোয়ের আয়োজন করা হলে ভালো হয়।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com